Thursday, February 19, 2015

উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজে প্রাচ্যতত্ত্বের নবায়ন প্রসঙ্গ

প্রাচ্যতত্ত্ব ও উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজ
লেখক : ফকরুল চৌধুরী
ফেরদৌস মাহমুদ 

ফকরুল চৌধুরী মূলত কথাসাহিত্যিক হলেও উত্তর-ঔপনিবেশিক পরিস্থিতি নিয়ে বেশ কিছু কাজ ও লেখালেখি করেছেন। সিভিল সোসাইটি নিয়ে তার একটি সমৃদ্ধ সম্পাদনা গ্রন্থ রয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তার প্রবন্ধগ্রন্থ ‘প্রাচ্যতত্ত্ব ও উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজ’। এই বইয়ে মোট ১২ টি প্রবন্ধ রয়েছে। দিনের পর দিন ফকরুল চৌধুরী নানা বিষয়ের পাশাপাশি প্রাচ্যতত্ত্ব ও ঔপনিবেশবাদ নিয়ে যে অধ্যয়ন, অনুশীলন ও গবেষণা করেছেন, বলা যায় প্রবন্ধগুলি তারই চুম্বক অংশ। এক্ষেত্রে পাঠজাত চিন্তার পাশাপাশি নিজস্ব চিন্তার মিলন ঘটিয়ে ফকরুল চৌধুরী প্রবন্ধগুলি রচনা করেছেন। কিন্তু বইটির নাম ‘প্রাচ্যতত্ত্ব  ও উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজ’ কেন?
প্রাচ্যতত্ত্ব শব্দটি শুনলে আমাদের মাথায় প্রথমেই আসে এডওয়ার্ড সাঈদের নাম। গত শতকের পরিবর্তনমুখী বুদ্ধিবৃত্তিক আবহে এডওয়ার্ড সাঈদ ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিশীল চিন্তাবিদদের একজন। ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত অরিয়েন্টালিজম সাঈদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ গ্রন্থে সাঈদ অঙ্গীকার করেন মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোয় ইউরোপের সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর রাজনৈতিক, সামাজিক, নৃ-তাত্ত্বিক, আর্থিক আধিপত্যের সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি ও প্রতিফলন- প্রাচ্যের ঐ অঞ্চলের ওপর পশ্চিমের কর্তৃত্ব, কর্তৃত্বের আরোপণ, তার উপায় ও ধরনের ইতিহাস রচনার। ঐ কর্তৃত্বের বা আধিপত্যের পেছনে কার্যকর সাংস্কৃতিক মনোভঙ্গি ব্যাখ্যা করার জন্য সাঈদ ব্যবহার করেন ‘অরিয়েন্টালিজম’ বা ‘প্রাচ্যতত্ত্ব’ পরিভাষাটি। প্রাচ্যতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাঈদ বলেন, ‘প্রাচ্য হলো পশ্চিমের জ্ঞান জগতের নির্মাণ; পশ্চিমের নিকট প্রাচ্য ছিলো দূর ও অজানা। সেই দূর ও অজানাকে জানার চেষ্টায় প্রাচ্য হয়ে উঠে পশ্চিমের ‘অন্য’ বা আদার - পশ্চিমের প্রতিপক্ষ। ফলে পশ্চিম (অর্থাৎ নিজ) হয় ভালো, ‘প্রাচ্য’ (অন্য) মন্দ। এ প্রাচ্য বাস্তব প্রাচ্য নয়, পশ্চিমের সৃষ্টি মাত্র। পশ্চিম প্রাচ্যে তার উপনিবেশ গড়ার বহু পূর্ব হতেই প্রাচ্যের ইতিহাস, জনগোষ্ঠী, সংস্কৃতি, বিশ্বাস সম্পর্কে অজ¯্র কাল্পনিক ধারণা সৃষ্টি করেছে, প্রচার করেছে, প্রজন্মক্রমে নিজেরা তা বিশ্বাসও করেছে। সে কল্পনা ও ধারণার মূলে আছে পশ্চিমের শ্রেষ্ঠত্ব প্রাচ্যের নিকৃষ্টতার বোধ। এ ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়েই পশ্চিম প্রাচ্যে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালায়।

এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইতিহাসবিদ কর্তৃক ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র’ পরিভাষাটি উত্থাপন করা হয়। উত্তর-ঔপনিবেশিকতার রয়েছে স্বাধীনতা-উত্তর সময়কাল নির্দেশ করার জন্য কালক্রমিক সংজ্ঞা। তবে  উপনিবেশায়নের বিভন্ন সাংস্কৃতিক পরিণাম আলোচনার ক্ষেত্রে সত্তুরের দশক হতে সাহিত্য সমালোচনায় এই পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। উত্তর-উপনিবেশবাদ মতাদর্শগত ও সংস্কৃতিগত ভাবে পশ্চিমা উপনিবেশবাদের ফলাফল নিয়ে পর্যালোচনা করে এবং অধিকন্তু এর পরিণাম বিষয়েÑ কোথায় এর ধারাবাহিক প্রভাব বিদ্যমান কিংবা সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন দেশে জাতিগত ও ব্যক্তিগত পরিচিতি নির্ধারণে ব্যাপ্ত থাকে।

বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে, এটা আকারপ্রাপ্ত হয় উপনিবেশবাদের দীর্ঘকালীন গবেষণার ফলে, এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন রচনাবলী বিশেষ করে এডওয়ার্ড সাঈদ, হোমি ভাবা এবং গায়ত্রী স্পিভাকের রচনাবলী এই তত্ত্বকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এইসব তাত্ত্বিক কর্মকা-ে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক উদ্যোগ এবং পশ্চিমা-বিরোধী মনোভাব ছিল।‘নিজ’  ও ‘অপর’ এর মধ্যকার প্রশ্ন, পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের উচ্চভিলাসী প্রাচ্যতত্ত্ব প্রয়াস উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব চর্চার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। 

‘প্রাচ্যতত্ত্ব ও উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজ’ বইটিতে আজকের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে পশ্চিমা সৃষ্ট প্রাচ্যতত্ত্বের নতুন ভার্সন কেমন, উত্তর ঔপনিবেশিক সমাজ কাঠামোর পরিস্থিতিই বা কী- সেটা তাত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ বইয়ের ১২ টি প্রবন্ধকে দুটি ভাগে ভাগ করে সাজানো হয়েছে। প্রথম ভাগের প্রবন্ধগুলো যথাক্রমে- ‘প্রাচ্যতত্ত্ব ও উপনিবেশবাদ’, ‘নয়া-প্রাচ্যতত্ত্ব : ব্যাখ্যান ও বিবেচনা’, ‘প্রাচ্যতত্ত্বের পূর্বাপর’, ‘ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষ, কাল্পনিক ভূমি এবং প্রাচ্যতত্ত্ব’, ‘প্রাচ্যতত্ত্ব ও ব্রিটিশ ভারত’, ‘খ- ভূগোল খ- চিন্তা’। এছাড়া দ্বিতীয় ভাগের প্রবন্ধ - ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজ এবং ক্ষমতার বিমার’, ‘বাদামি চামড়া সাদা মন’, ‘উপনিবেশের সেকাল একাল’, ‘সভ্যতার সংকট ও সংঘাত’, ‘হিংসার উদ্ভব ও পাল্টা হিংসা’, ‘গান্ধী : স্থান কাল পেরিয়ে’।
প্রথম প্রবন্ধ ‘প্রাচ্যতত্ত্ব ও উপনিবেশবাদ’- এ বিশ্লেষণ করা হয়েছে এডওয়ার্ড সাঈদের ‘অরিয়েন্টালিজম’- এর আলোকে প্রাচ্যতত্ত্ব বিষয়ে। দেখানো হয়েছে কিভাবে বিভিন্ন প্রকারের তিক্ত সমালোচনা ও অসহিষ্ণু আক্রমণের পর অরিয়েন্টালিজম গত তিন যুগ যাবৎ বিদ্যাবুদ্ধির ভূমিতে প্রভাবশালী ও আলোচিত। এভাবেই একে একে অন্যান্য প্রবন্ধে লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশ, ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী দেশগুলোর বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরে দেখানো হয়েছে কিভাবে বর্তমানে উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজে নয়া-উপনিবেশবাদের আবির্ভাব ঘটেছে। গত কয়েক বছর ধরে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, মিশরকে কেন্দ্র করে যে বৈশ্বিক সংকট ও যুদ্ধ পরিস্থিতি এর কারণ তাত্ত্বিকভাবে অনুসন্ধান করা হয়েছে। বিশ্লেষণ করা হয়েছে ‘আরব বসন্ত’ কথাটির আড়ালে যে গণতন্ত্রের কথা উচ্চারিত হচ্ছে তা আদৌ গণতন্ত্র নাকি পশ্চিমাদের তেল লুটের ফন্দি। বিভিন্ন কোটেশন ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে প্রাচ্যতত্ত্বের সঙ্গে উপনিবেশবাদের কিভাবে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কিভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো নয়া সা¤্রাজ্যবাদের জালে বন্দি হয়ে আছে। ফকরুল চৌধুরী প্রসঙ্গক্রমে উপনিবেশের সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের যোগসূত্র সম্পর্কে লিখেছেন-

‘তৃতীয় বিশ্ব মূলত সাবেকী উপনিবেশ দেশগুলোর সমাহার। এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার দারিদ্র্য-জর্জরিত দেশগুলো। এসব দেশ শিল্পোন্নত ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ‘প্রথম বিশ্ব’ এবং বিলুপ্ত কমিউনিস্ট দেশগুলো নিয়ে গঠিত ‘দ্বিতীয় বিশ্ব’ থেকে আলাদা। ‘‘তৃতীয় বিশ্ব খুবই সম্পদশালী। দরিদ্র কেবল এসব দেশের মানুষ। সীমাহীন লুণ্ঠনের কারণেই শুধু এর মানুষের দারিদ্র।’’ বেশির ভাগ পশ্চিমা প-িত তৃতীয় বিশ্বের ‘দারিদ্র্য’ ও ‘অনুন্নয়ন’ কে একটি মৌলিক ঐতিাসিক অবস্থা হিসেবে  বিবেচনা করে থাকেন। বিশ্বাস করতে বলা হয় যে, এসব দেশের  অবস্থা চিরকাল এমনই ছিল। আলস্য আর উৎপাদনবিমুখ এখানকার মানুষের স্বভাবজাত। কিন্তু চাপিয়ে দেওয়া ইতিহাসের ফাঁকফোকরে অনেক সত্য বেরিয়ে আসছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রয়েছে খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের বিপুল ভা-ার; সুপ্রাচীনকাল থেকেই উৎপাদিত হচ্ছে খাদ্যশস্য। সম্পদের সুষম ব্যবহার আর শ্রমের আনন্দে এরা নিজভূমে আনন্দেই থেকেছে। খাদ্য কিংবা সম্পদের জন্য এদের পরদেশ আক্রমণ জরুরি হয়নি। বরং কথিত তৃতীয় বিশ্বের সম্পদ লুট কিংবা মুনাফা অর্জনের জন্য ইউরোপীয় দেশসমূকে বিপদ-আপদ মাথায় বয়ে আসতে হয়েছে। দস্যুবৃত্তিক কৌশলের মাধ্যমে এখানে উপনিবেশ স্থাপন করেছে।  কয়েক শতাব্দী ধরেই বিবিধ লুটতরাজ চালানো হয়েছে, বলা যায় ১৪৯২ সালে কলম্বাসের আমেরিকা অভিযানের পরই এই প্রক্রিয়ার শুরু। তা আজও চলছে। এভাবে বহু শতাব্দী ধরে চলে আসা উপনিবেশবাদের সঙ্গে গাঁটছাড়া বাঁধা নানা তত্ত্ব সা¤্রাজ্যের অপরিহার্যতা প্রমাণে সচেষ্ট থাকছে। ’ ( উপনিবেশের সেকাল ও একাল, পৃষ্ঠা :১৩৭)

ফকরুল চৌধুরী দেখিয়েছেন, আজকের তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর যেরকমভাবে নানা সংকটে আক্রান্ত তা আসলে নয়া উপনিবেশবাদের কারণেই সৃষ্ট। যাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি হল উপনিবেশবাদের বাজে সৃষ্টি। এসব দেশগুলোতে নানা প্রক্রিয়ায় সংকট জিইয়ে রাখা হয়েছে। একবাল আহমদের মতে, তৃতীয় বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের জন্য, অতীতের অভিজ্ঞতাজাত বিকল্পগুলি হচ্ছে একটি ত্রিশঙ্কু অবস্থানজমি থেকে বিচ্ছিন্নতা, বস্তিতে বসবাস, দেশত্যাগ করে বিদেশ-বিভুঁইয়ে থাকা, আর সবচেয়ে ভালো অবস্থা হলো, সর্বক্ষণ আশা-নিরাশার এক দোলাচালের মাঝে বাস করা। এখানে ঘটেছে বিচ্ছিন্ন সত্তার বৃহৎ সমাহার। জাতীয়তা বোধের বড় অভাব। জাতীয় নেতৃত্বের আপসকামিতা ও অযোগ্যতা জনগণকে ধারাবাহিকভাবে হতাশার মধ্যে নিপতিত করেছে। দেশ সাবেকী ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে গাঁটছাড়া বাঁধা দেশীয় শাসকশ্রেণী অনেকটা প্রতিনিধিরূপে দেশ পরিচালনা করছে। তারা শাসন, শোষণ ও দমনে সাবেক প্রভুদের চেয়ে কম পারদর্শী নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে বেশিই।  দেখা যায়, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ত্যাগী নেতা সদ্য স্বাধীন দেশে ক্ষমতাসীন হয়ে পরদেশী শাসকের চরিত্রে অভিনয় করছে।

উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের শাসকরা এক ধরণের রোগে ভোগেন। একবাল আহমদ এই রোগের নাম দিয়েছেন ক্ষমতার বিমার। ক্ষমতাবানদের যেখানে ভাবার কথা বৃহত্তর জনগোষ্ঠির বাঁচামরার সমস্যার কথা। সেখানে উল্টো  ক্ষমতাবানদের কলহের দায় আরোপ হচ্ছে সাধারণ জনগণের ওপর। টালমাতল অবস্থায় অনেক জনপ্রিয় সরকারও ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ে, আবার অনেক জনপ্রিয় সরকার নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীয়র্ণ হয়। অশুভ শক্তি ক্ষমতাকেন্দ্র দখলে নেয়। এসব দ্বন্দ্ব উসকে দিতে সাবেকী ঔপনিবেশিক শক্তি কিংবা সমমনাদের অদৃশ্য হাত বিপুল উৎসাহে নিয়োজিত থাকে। অন্ধ শাসকশ্রেণী তা বুঝতে পারে না। মাঝখান থেকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি ক্ষমতার বিমার থেকে কোনোভাবেই মুক্তি পায় না। এই ক্ষমতার বিমারের ধরণ নিয়ে বইটির দ্বিতীয় পর্বের প্রবন্ধগুলিতে আলোচনা করা হয়েছে।
বইটিতে প্রসঙ্গক্রমে উঠে এসেছে বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রসঙ্গও। এতে বাংলাদেশের গত কয়েক বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোন থেকে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। দেখানো হয়েছে ক্ষমতার বিমার থেকে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরাও মুক্ত নন। স্বাধীনতার বেয়াল্লিশ বছর পরও বাংলাদেশের রাজনীতি ক্ষমতার বিমারে আক্রান্ত। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনে থেকে এখানে নানা ক্ষত তৈরি হয়েছে। যাপিতজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র বিকৃত করা হয়েছে।  সম্পদ লুণ্ঠনের সঙ্গে মস্তিস্ক বেদখল হয়েছে। এর পরিণামে ভুগছে জনগণ। শাসকশ্রেণীর মধ্যে চরম অসহিষ্ণুতা বিরাজ করছে। প্রধান দলগুলোর মধ্যকার সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি লেগেই আছে। হীনম্মন্যতা পরাজয়মনস্কতা জারি রেখেছে। দলগুলো চরম ক্ষমতামুখীÑ রাজনৈতিক দলের জন্য এটাকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিলেও প্রশ্ন থেকে যায়। বিদেশী দূতাবাসসমূহ এদেশে প্রকাশ্যে যেসব কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে তা স্বাধীন দেশের জন্য লজ্জাকর। প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূতগণ এদেশে সাল্লিশির কাজ করে থাকে। এমন পরিস্থিতির নেপথ্যে রয়েছে রাজনীতি। রাজনীতি তাই জনগণকে এড়িয়ে চলতে সাহস পাচ্ছে, কিন্তু বহিঃশক্তিকে এড়াতে পারছে না।
বইটিতে গান্ধীকে নিয়ে রয়েছে একটি বিশ্লেষকমূলক দীর্ঘ প্রবন্ধ। যেখানে গ্রামসির নিস্ক্রিয় বিপ্লব ও গান্ধীর নিস্ক্রিয় প্রতিরোধের তুলনামূলক আলোচনার পাশাপাশি বিশ্লেষণ করা হয়েছে গান্ধীর অহিংস মতবাদ কিভাবে বুর্জোয়া কাঠামোকেই সহায়তা করে কিংবা গান্ধীর স্বদেশী চিন্তায় লালিত জাতীয়তাবাদী চিন্তা আজও কেন প্রাসঙ্গিক। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে ব্রিটিশ আমলের স্বদেশী আন্দোলন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর চিন্তাগত দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গ। আলোচনা করা হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলিতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ হলেও শেষপর্যন্ত তা ঔপনিবেশিক মানসিকতা দ্বারা আক্রান্ত। আজও প্রাচ্যতত্ত্ব তৃতীয় বিশ্বের উত্তর ঔপনিবেশিক সমাজে শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্যের ভেতর দিয়ে পশ্চিমা রুচি ছড়িয়ে দিচ্ছে। শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে পশ্চিমারা তৃতীয় বিশ্বে সরাসরি উপস্থিত না থেকেও তাদের শোষণ প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রবন্ধগুলোতে ফকরুল চৌধুরীর চিন্তাভাবনার গাথুনির সমর্থনে দীর্ঘ একসারি লেখক ও তাত্ত্বিকের বাদানুবাদ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এসব লেখকের চুম্বক-চিন্তন এখানে নানাভাবে উঠে এসেছে। এদের তালিকা প্রদান করা যেতে পারেÑ এইমে সেজেয়ার, ফ্রাঞ্জ ফানোঁ, এডওয়ার্ড সাঈদ, একবাল আহমদ, মাহমুদ মামদানি, মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমর্ত্য সেন, নগুগি ওয়া থিয়োঙ’গ, মাইকেল প্যারেন্টি, সমীর আমিন, রণজিৎ গুহ, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, হোমিভাবা, ডেরেক গ্রেগরি, এজাজ আহমেদ, হামিদ ডাবাশি, রামশরণ শর্মা, জওহরলাল নেহরু, বার্নাড লুইস, স্যামুয়েল হান্টিংটন প্রমুখ লেখক, কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ ও চিন্তাবিদদের বিভিন্ন প্রসঙ্গ। মনে হবে যৌথ প্রযোজনায় রচিত হল অনবদ্য একটি গ্রন্থ। তবে শেষাবধি সবকিছু ছাপিয়ে লেখক নিজের পথেই হেঁটেছেন। আর সেটি হল চোখ বুঝে সব কিছু মেনে নেয়া নয়, প্রশ্ন করে নিজের অস্তিত্বসংলগ্ন বাস্তবতাকে পরখ করে দেখা। 
ফকরুল চৌধুরীর ‘প্রাচ্যতত্ত্ব ও উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজ’ বইটি একটি সময়োপযোগী  উদ্যোগ। বইটি পাঠ মাত্রই পাঠক দেশ, কাল ও বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নের শক্তির অনিবার্যতা বোধ করবে।  বইটি তত্ত্বানুসন্ধানী ইতিহাস ও রজনীতি সচেতন পাঠকদের চিন্তজগতকে সমৃদ্ধ করবে আশা করা যায়।


প্রাচ্যতত্ত্ব ও উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজ, লেখক : ফকরুল চৌধুরী, প্রকাশক : কথাপ্রকাশ, প্রচ্ছদ : সব্যসাচী হাজরা, প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১৪, মূল্য : ২৫০ টাকা

No comments:

Post a Comment