Tuesday, March 22, 2016

লড়াকু সংস্কৃতি ও সংগ্রামী চেতনা

ফকরুল চৌধুরী


সমাজ কিংবা মানুষ বিহীন কোন সংস্কৃতি হয় না। পৃথিবীতে মানবজন্মের আগের ও পরের অবস্থার পার্থক্য মূলত একটি সাংস্কৃতিক তফাত। আমাদের কৃষি সমাজ ‘কৃষ্টি’ বা ‘সংস্কৃতি’ শব্দের উদ্ভবগত প্রত্যয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কৃষি করে পাওয়া কৃষ্ট দ্রব্য অর্থাৎ কৃষ্টি হল মানুষের উদ্ভাবনী ও সৃজনী মনের কার্যকলাপে রূপান্তরিত বস্তু; এ বস্তু অর্জন করতে হয়েছে। পতিত বা প্রকৃতগত জমি চাষাবাদের মাধ্যমে আবাদ করে তবেই ফসল পাওয়া যায়। তেমনি অভিজ্ঞতা, শিক্ষা-দীক্ষা, চর্চা ও পরিশীলনের মাধ্যমে আদিম মানুষ রূপান্তরিত হয়ে সংস্কৃতিবান মানুষ হয়ে ওঠে। এভাবে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাপার দুটো আর সমরূপ থাকে না। মানুষের কার্যকলাপের ফলে যে জাতদ্রব্য বেরিয়ে আসে তা আর প্রাকৃতিক থাকে না, তা সাংস্কৃতিক। একদিকে চলছে প্রাকৃতিক ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়াগুলো আর অন্যদিকে মানুষের সচেতন, সৃজনশীল ও বাসনানুযায়ী পরিচালিত ক্রিয়াকলাপের দুটো প্রবাহ। প্রাকৃতিক ব্যাপার সমূহ থেকে পৃথক হয়ে মানুষের সৃজনশীল কার্যকলাপের মোট ফলাফলকে আমরা সংস্কৃতি আখ্যায় ভূষিত করে থাকি।
সংস্কৃতি খুবই বিস্তৃত ধারণা, এর ব্যাপ্তি পরিসর বিপুলাকার। সামাজিক জীবন আর ক্রিয়াকলাপের সব ক্ষেত্র প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সংস্কৃতির উপাদান বলে বিবেচ্য। তবুও সংস্কৃতির সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞায়ন আজ অবধি সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে বিতর্ক চলমান। তবে সংস্কৃতি নিয়ে দুটি ধারণা সুস্পষ্ট, তা হলো সঙ্কীর্ণ ও বিস্তীর্ণ ধারণা। সঙ্কীর্ণ ধারণা অনুযায়ী সংস্কৃতিকে সৃজনশীল ক্রিয়াকলাপ, যেমন- শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান ইত্যাদি আর তার ফলাফল, এবং জনগণের মধ্যে সেগুলোর প্রসার বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে বিস্তীর্ণ ধারণায় মানুষের ক্রিয়াকলাপের সব ফলÑ বৈষয়িক আর মানসিকÑ উভয়ই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতি যা তৈরি করে না সেসব কিছুই সংস্কৃতির উপাদান। লেখক কর্তৃক উপন্যাস লেখা যেমন সংস্কৃতি, তেমনি ছুতার কর্তৃক চেয়ার তৈরিও সংস্কৃতি। কৃষি যন্ত্রপাতি, চাকা কিংবা গাড়ি প্রকৃতি তৈরি করে না, তাই এগুলো সংস্কৃতির উপাদান। মানুষের হাত ও মস্তিষ্কের কাজের ফলে এসবের সৃষ্টি হয়েছে। এতে মূর্ত হয়েছে মানুষের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও সৃজনশীলতা। মানুষের তৈরি করা প্রত্যেকটি ভৌতিক বস্তু প্রথমে অস্তিমান হয় একটি ভাব-ধারণা হিসেবে, সেটা মানুষের মানসিক সৃজনশীলতার একটি ফল। তাই সাংস্কৃতিক মর্মবস্তুকে শুধু মানস সংস্কৃতির প্রতিভু ভাবা অসমীচীন। ক্যানভাবে যিনি ছবি আঁকছেন তিনি যেমন সংস্কৃতিকর্ম করছেন, তেমনি কোন মিস্ত্রী যখন নৌকা তৈরি করছেন, তিনিও সংস্কৃতি চর্চাই করছেন। তবে বৈষয়িক সংস্কৃতির ভোগ-ব্যবহারে ক্ষয় আছে, তাই অবিরাম পুনরুৎপাদন হওয়া চাই। আর মানসিক সংস্কৃতি সমাজের অঙ্গস্বরূপ, কখনও তা অক্ষয়, কখনও অবক্ষয়। মোদ্দাকথা, সমাজ হল বৈষয়িক আর মানসিক ক্রিয়াকলাপে উদ্ভূত বস্তুর সৃষ্টি, প্রসার আর ভোগ-ব্যবহারের প্রক্রিয়া।

সমাজ সমসত্ত্ব নয়, এখানে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ বসবাস করে। আর প্রত্যেকের সাংস্কৃতিক ছাঁচ বা ছক আলাদা। মানবজাতির উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গেই আদিম সংস্কৃতির উন্মেষ। আদিতে মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠিতে বিরাজমান সংস্কৃতি ছিল সুস্থিত ও অনেকটা অপরিবর্তনীয়। গোষ্ঠি জীবনে একাট্টা ও সুদৃঢ় শৃঙ্খলা গঠনে সংস্কৃতি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। তখন সংস্কৃতি মানে আচরণ ও ক্রিয়াকলাপের পূর্ব-নির্ধারিত কিছু বিধি-বিধান। খাদ্যান্বেষণকে কেন্দ্র করে পশু শিকারের কৃৎকৗশল ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার যৎসামান্য নজির ছিল সংস্কৃতির উপাদান। এসব গোষ্ঠিবদ্ধ মানুষের পারিপাশির্^কের সঙ্গে অভিযোজিত হওয়া, বাসিন্দাদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য বিশেষ প্রয়োজন ছিল। তা যতই বাঁধা-ধরা ছকের ব্যাপার হোক, এর মধ্যেই গড়ে উঠেছিল স্বাচ্ছন্দ্যময় সংস্কৃতিতন্ত্র। সংস্কৃতিতন্ত্রের মধ্যে কঠোরভাবে আবিষ্ট ছকগুলো নানা পুনর্গঠন সত্ত্বেও পরম্পরাগত অভ্যাস হিসেবে বিবেচ্য। কোন গোষ্ঠিতে অন্তর্ভুক্ত মানুষের তৈরি এসব পুরুষানুক্রম ছকগুলো স্পষ্ট-অস্পষ্ট, যুক্তি-অযুক্তি, গোপন-প্রকাশ্য ইত্যাদি নানা মাত্রার পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থেকে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আর এটাই সংস্কৃতি। এ অর্থে সংস্কৃতি মানুষের ক্ষেত্রে প্রজাতিবদ্ধ এবং একটি অনন্য ঘটনা। তবে তা অক্ষত নয়, একে অপরিবর্তনীয় রাখা ও রক্ষা করা মানে সংস্কৃতি ও প্রগতির পথ রুদ্ধ করা।

২.

সংস্কৃতি মানবতন্ত্রের একটি সর্বজনীন ঘটনা বটে, তবে কোন অনড় বিষয় নয়, এর রূপান্তর ঘটে। এটা হয়ে থাকে অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে বোঝাপড়ায়, আবার নিজ সমাজের মধ্যে নতুন কোনো উদ্ভাবনার প্রভাবে। তাই বর্তমান দুনিয়ায় এক সংস্কৃতি থেকে অন্য সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশ দুরুহ কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু আদি সংস্কৃতিতন্ত্রে ব্যাপারটি ছিল কঠিন। তখন এক সংস্কৃতিতন্ত্র থেকে আরেক সংস্কৃতিতন্ত্রে যেতে হলে গড়ে-তোলা একগুচ্ছ অভ্যাস ও আচরণবিধির আমূল পুনর্গঠন অনিবার্য হয়ে পড়ত। এভাবে ভিন্ন সংস্কৃতিতে অভিযোজিত হওয়া ছিল রীতিমতো অসাধ্য। এ অবস্থা আজকের প্রেক্ষাপটে সত্য না হলেও, অর্ধসত্য। বর্তমানে বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে আদান-প্রদান ও গমনাগমন অধিকতর হচ্ছে বটে, কিন্তু কেউই নিজস্ব সাংস্কৃতিক ব্যাকরণ সমর্পণ করতে আগ্রহী নয়। যতই বিশ^ায়ন কিংবা মুক্ত বিশে^র কথা বলা হোক, সমান্তরালে চলছে নিজ সংস্কৃতি সুরক্ষার অধিকতর ঝোঁক। একটি সংস্কৃতিতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে লালিত-পালিত মানুষ-সংস্কৃতি এক ধরনের সাংস্কৃতিক ব্যাকরণ তৈরি করে। পবিত্র সরকারের ভাষায়, “সংস্কৃতিতে মানুষ শুধু নানা প্রাকৃতিক উপাদান থেকে বস্তু ও উপকরণ তৈরি করে না, সেগুলোকে সরল বা জটিল নানা সংগঠনের আওতায় আনে এবং সেগুলির পরস্পরের সঙ্গে নানা সম্পর্ক তৈরি; নিজের ব্যবহারের সুবিধার জন্য সেগুলিকে বিন্যাস করে।” 

সংস্কৃতি অনেকটা ভাষার সমগোত্রীয়। ভাষার মতো এর একটি প্রতীকমূলক ধর্ম রয়েছে। নিজ ভাষার দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দগুলোর একটি বিশেষ অর্থ থাকে, যা অন্য ভাষার মানুষের কাছে বার্তাবহ নয়। অথচ নিজ ভাষার লোকের কাছে তা একটি বার্তা পৌঁছে দেয়। অনুরূপভাবে প্রতিটি সাংস্কৃতিক ব্যাপারও কিছু স্পষ্ট নির্দিষ্ট বার্তার প্রতীকী বাহক, যা ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের কাছে অস্পষ্ট ঠেকে। তত্ত্বজ্ঞগণ ভাষাকে সংস্কৃতির বাহন হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। ভাষাকে আয়ত্ত করতে যেমন তার বাগ্ধারা আয়ত্ত করা প্রয়েজন হয়, সংস্কৃতিকে আয়ত্ত করতে গেলেও তার বাগ্ধারা আয়ত্ত করা প্রয়োজন। সংস্কৃতি ও ভাষা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে বহু মানুষকে একসূত্রে বাঁধতে ভূমিকা রাখে। অনিবার্য কারণেই, সাধারণভাবে ভাষা দ্বারা সংস্কৃতির সীমানা নির্ধারিত হয়ে থাকে।

সংস্কৃতি লোকসমাজের একটি শক্তি। লোকসমাজ গঠনে সংস্কৃতির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে বিশেষ মতানুযায়ী, প্রতিটি সংস্কৃতিতন্ত্র একটি সম্পূরিত সমগ্র সত্তা। সংস্কৃতিকে সমগ্র মানবজাতির সম্পত্তি রূপে গণ্য করা হয়। এই অর্থে বিশ^সংস্কৃতি হল বৈচিত্র্যের একত্ব, মানে একত্ববিহীন বৈচিত্র্য নয়। যেখানে প্রতিটি সংস্কৃতিই সমমর্যাদার দাবিদার, যেখানে কেন্দ্র-প্রান্তিক কিংবা মার্গীয়-অচ্ছুৎ সংস্কৃতি বলে কিছু থাকার নয়। প্রতিটি সংস্কৃতিতন্ত্রের মধ্যে লোকসমাজ অসাধারণ অভিযোজ্যতার মধ্যে লালিতপালিত হয়। তাই কোনো সংস্কৃতিকে তথাকথিত কোনো মান-সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে গুণবিচারি করা সঠিক হবে না। নৃবিজ্ঞানচর্চার প্রারম্ভে এই ধরনের উদ্দেশ্যমূলক প্রয়াস লক্ষ করা গেলেও পরবর্তীতে বিদ্যায়তনিক বিষয়টি গণতান্ত্রিক ধারায় প্রবাহিত হয়ে জাতি-বর্ণ বিভেদ উপেক্ষা করেছে। প্রথিতযশা নৃবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সংস্কৃতিকে উচ্চতর আর নি¤œতর শ্রেণীতে বিভক্ত করার সিদ্ধান্তে সায় দেননি। তারা মনে করেন, প্রত্যেকটি সংস্কৃতি অনন্য, একটাতে অভিযোজিত হয়ে গেলে ভিন্ন সংস্কৃতিতন্ত্রে প্রবেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। মোদ্দা কথা, সংস্কৃতি যে-কোন লোকসমাজের জন্য তাদের অস্তিত্বসংলগ্ন বাস্তবতা। সংস্কৃতি বিপর্যয়ে তাই অস্তিত্বের সঙ্কট তৈরি হয়।

 ৩.

জাতিবৈর ও উপনিবেশবাদী মতাদর্শ ‘অপর’ সংস্কৃতিকে কখনো সুনজরে দেখেনি। বিভিন্ন সংস্কৃতি সমান সমানÑ বৈরগস্ত সমাজ এ সত্য সর্বদা অমান্য করেছে। ঔপনিবেশিক শক্তি- জাতিসমূহ, যা মূলত সংস্কৃতির বাহন, তাদের স্বাধীন অস্তিত্বের অধিকার সর্বদা খর্ব করার প্রয়াস চালিয়েছে। এ ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনের পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফলে দখলী ও নিপীড়িত জাতিগুলির সংস্কৃতি অবদমিত হয়েছিল। তাদের তীব্র নিপীড়নে কখনো গোটা লোকসমাজ ও তাদের সংস্কৃতি চিরতরে বিনাস হয়ে গিয়েছিল। আমরা স্পানিশ কর্তৃক ইনকা ও মায়া সভ্যতা ধ্বংসের কাহিনি জানি। ঔপনিবেশিক বর্বরতায় আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করার রক্তাক্ত ঘটনার বিষয়ে আমরা অবহিত। সুনির্দিষ্ট কারণেই, উপনিবেশবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদ কখনও বহু সংস্কৃতির সুহৃদ হতে পারে না। বাস্তবতা হলো, এ দুটি আপদই নয়ারূপে দুনিয়াব্যাপী কর্তৃত্ববিস্তারে কার্যকলাপ অব্যাহত রেখেছে।

বাংলাদেশ সমাজে ঔপনিবেশিক ক্ষত আজও বিদ্যমান। কখনও মনে হয়, ক্ষত খুঁচিয়ে দিনকে দিন আরও রক্তাক্ত করা হচ্ছে। শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের ব্রতী হয়ে প্রথমে পাকিস্তান, পরে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে বটে, তবে শোষণের ইতি ঘটেনি। ব্রিটিশ উপনিবেশ নেই বটে, আছে তাদের নীতি। ইংরেজী শিক্ষার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শক্তি শ্যামলা চামড়ার যে ইংরেজ সৃষ্টি করেছিল, তারা যে দো-আঁশলা সংস্কৃতি ধারণ করেছিলে- তা এখনও পুনরুৎপাদনশীল। শিক্ষার ভাষা ইংরেজীকরণের মাধ্যমে বদলে দেয়া হয়েছিল নিজ সংস্কৃতির স্বাভাবিকতা। এমন একটি সাহিত্য পরিম-ল সৃষ্টি করা হয়, মানে-গুনে আশ্চর্য শক্তিমত্তার পরিচয় দিলেও তা জনগণের হয়ে উঠেনি। উপরন্তু বাছবিচার না করেই পশ্চিমা মতাদর্শগুলো ধারণ করেছিল সেকালের আলোকিত মানুষেরা। ফলে সংস্কৃতি ‘দেবে আর নেবে’ মানদ- উপেক্ষা করে আত্মসমর্পনের উপকরণে পরিণত হয়। নিজ সংস্কৃতি হয় আরোপিত; তা বিকশিত ও পরিপক্ক হওয়ার পথ হারায়। সংস্কৃতির বিকৃত ভাঙচুর ও গতিরুদ্ধ হয়। স্বাভাবিকতা হারায়। তবে বিনাশ ঘটেনি।

বর্তমানে কর্তৃত্বপরায়ন ক্ষুদ্র লুটেরা ও দুর্বৃত্তপরায়ন গোষ্ঠি এবং তাদের তল্পিবাহক বিদ্বৎসমাজ মিলে যে তন্ত্র সৃষ্টি হয়েছে, তা ঔপনিবেশিক শক্তির দৈশিক উত্তরাধিকার মাত্র। এদের সৃষ্ট সংস্কৃতি এক ধরনের ঘোর বা মুগ্ধতা তৈরি করেছে,  আদায় করতে পেরেছে সমাজের সাধারণ স্বীকৃতি। প্রকারন্তে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণাপত্রের মর্মবাণী, বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচারের নিশ্চয়তা বাস্তবে প্রতিফলিত হয়নি। সমাজে সাংস্কৃতিক বিভেদ তীব্রভাবে পরিলক্ষিত। অপরকে অস্বীকারের সংস্কৃতি চর্চা লক্ষণীয়। আমাদের এই সঙ্কট এক অর্থে যেমন সাংস্কৃতিক, তেমনি ঔপনিবেশিক। উনিশ শতকীয় রেনেসাঁর আলোয় যে বিদ্যাবুদ্ধি ও মানসিকতা গড়ে উঠেছিল তা জনবিচ্ছিন্ন হওয়ায় সমাজে গেড়ে বসতে পারেনি, কিন্তু কর্তৃত্ব আজ অব্দি বহাল রয়েছে। সে-সময় পূর্ববঙ্গের জনমানুষ ঔপনিবেশিক মেট্রোপলিটান শহর কলিকাতার বাতির আলোয় আলোকিত ছিল না, অন্ধকারাচ্ছন্ন ঢাকায় পরবর্তীতে কিভাবে উপনিবেশ-উদ্ভূত আলোর ছটা সংক্রমিত হল তা যেমন একটি বিস্ময়কর প্রশ্ন, তেমনি অনুসন্ধানের বিষয়। বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কর্তৃত্বারোপের এক লীলাক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এদেশের সাধারণ মানুষের ওপর তিন সাংস্কৃতিক শাসন স্পষ্ট নির্ণীত। প্রথমত, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক মতাদর্শ থেকে উদ্ভূত সংস্কৃতির অবশেষ, যা এখনও শাসকশ্রেণি ও বিদ্বৎসমাজের মনন তৈরিতে ভূমিকা রাখছে; দ্বিতীয়ত, বিশ^ায়নের নামে পুঁজিতান্ত্রিক সংস্কৃতি, যার মূল লক্ষ্য হলো মুনাফাভিত্তিক মনোপলি সংস্কৃতির আধিপত্য আরোপ; আর তৃতীয়ত, দেশীয় শাসকশ্রেণী কর্তৃক আরোপিত সংস্কৃতি, এ সংস্কৃতি পরজীবীমনস্ক। সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে উপলব্ধি করা সম্ভব যে, শাসক এই তিন সংস্কৃতিই উপনিবেশবাদের সঙ্গে গভীরভাবে প্রোথিত।

সমাজে সাংস্কৃতিক সুষ্ঠুতা ফিরিয়ে আনতে প্রথমেই উপনিবেশবাদের প্রভাব দূর করতে হবে। স্মর্তব্য, একটি সংস্কৃতি যতই পীড়নের সম্মুখীন হোক না কেন, একে নিশ্চিহ্ন করা যায় না। উপনিবেশের আলোকিত শহরগুলোর সীমানার বাইরের অন্ধকার পল্লীতে ঠিকই নিজ সংস্কৃতির চিহ্নাদি সংরক্ষিত থাকে। সংস্কৃতির বাগ্ধারা ঠিকই বৃহত্তর জনগোষ্ঠির স্মৃতিতে থেকে যায়। এ বাগ্ধারা হয়তো অবদমিত হয়, স্থানচ্যুত হয় কিন্তু বিনাশ হয় না। এক্ষেত্রে দরকার সংস্কৃতির ওপর প্রলেপ পড়া ঔপনিবেশিক ধুলোর স্তরটি সরিয়ে ফেলা। অর্থাৎ সংস্কৃতির বিউপনিবেশায়ন। এ কর্মের শক্তি আসবে কোত্থেকে? সংস্কৃতির মধ্যেই শক্তি বিদ্যমান। এতদঞ্চলের সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে লড়াকু মানসিকতার অজস্র নজির। সংগ্রামী চেতনা আমাদের সংস্কৃতির অনন্য অঙ্গ।

৪.

লোকসমাজের বিউপনিবেশায়ন শুরু হয় সংস্কৃতি দিয়ে। বিউপনিবেশায়নের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য অর্থাৎ ভূমি ও মানুষের মুক্তি অর্জন করতে হলে, এই সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে লড়াকু দৃষ্টিভঙ্গি। এজন্য প্রয়োজন যোদ্ধা বা লড়াকু মানুষ। এটা ভিন্ন বিউপনিবেশায়নের সব প্রয়াস সহযোজন ও আয়ত্তকরণ হয়ে উঠবে অরক্ষণীয়। লড়াকু মানুষ প্রতিরোধ ও সংগ্রামী চেতনা প্রতিকায়িত ও প্রতিনিধিত্ব করে থাকে।
আমরা যখন স্থানীয় লোকজনের ওপর উপনিবেশবাদের প্রভাব বিবেচনা করি, এর মধ্যে পড়ে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, পরিচিতি সংকট, হীনম্মন্যতাবোধ ইত্যাদি। উপনিবেশস্থাপনকারীরা নানা কায়দায় স্থানীয়দের দেহ-মন রোগাক্রান্ত করে তোলে। তখন সমাজে মদ্যাসক্তি, মাদকাসক্তি, সামাজিক সহিংসতা এবং সামগ্রিক কর্মহীনতা বৃদ্ধি পায়। যুবকদের মধ্যে আত্মহননের প্রভাবও লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। আমরা যদি সেকালের বটতলার সাহিত্য এবং কালিঘাটের চিত্রগুলো পর্যবেক্ষণ করি তাহলে বিপদগ্রস্ত তারুণ্য, ইংরেজিয়ানা বাঙালির বাবু ও শেকড়চ্যূত মধ্যবিত্তের উম্মূল ও হাস্যকর কা-কারখানাই দেখব। এগুলো হলো দমিত ও পরাজিত লোকজনের অসুখ। এই অবস্থায় উপনিবেশিত জনগোষ্ঠি কার দ্বারা তাদের এহেন পরিণতি তা হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয় না। তারা অস্তিত্বসংলগ্ন বাস্তবতা বিস্মৃত হয়ে কল্পলোক অধিবাসী হয়। এ কল্পনাশক্তি শিল্পসাহিত্যের উৎকর্ষতায় কাজে লাগলেও মুক্তির পথ কন্টকিত করে তোলে। অবশ্য এক সময় নানা কানাগলি পেরিয়ে ইতিহাস ও পরীক্ষার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক নিপীড়নের বাস্তবতা ঠিকই চক্ষুষ্মান হয়ে ওঠে, মানুষ তখন জেগে ওঠে। এটা হল লড়াকু মানুষের চাপিয়ে রাখা সংস্কৃতি, যা মানুষকে অনুপ্রেরণা যোগায় প্রয়োজনীয় লড়াকু দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে। এজন্য লড়াকু সমাজ, সংগঠন ও সংস্কৃতি প্রারম্ভিক ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বারা নৃশংস আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়। একই কারণে এই লড়াকু মানুষেরা আজ উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজে কর্তৃত্বপরায়ন শ্রেণীর নিষ্পেষণ ও প্রজ্ঞাপনের প্রধান লক্ষ্যবস্তু রয়ে গেছে। 

তাই গোড়া থেকে, লড়াকু সংস্কৃতিকে যে কোনো বিউপনিবেশায়ন প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে খুবই গুরুত্বারোপ করা হয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত লড়াকু সমাজের ঐতিহ্যগত দায়িত্ব, সংগঠন ও পদ্ধতি; সঙ্গীত, কুলচিহ্ন ও রাজদ-। আজকাল, এ লড়াকু সংস্কৃতির আরও অন্তর্ভুক্তি হলো পরিচ্ছেদ, মুখোশ ও সরাসরি কার্যকলাপ (যেমন, অবরোধ, অধিকরণ) এবং প্রতিরোধের সাম্প্রতিক ইতিহাস। আমাদের সংগ্রামী চেতনা সর্বদা সজীব। তিতুমীর-শরিয়তুল্লাহর লড়াই, ফকির-সন্ন্যাসি বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানসহ অজ¯্র জনযুদ্ধ, আর আমাদের মহত্তম সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ। সবই প্রাতস্মরণীয় নজির। পূর্ববঙ্গের হাজার বছরের ইতিহাসের পরম্পরাগত যুদ্ধের ফলাফল হল মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের জনগণ, বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে নৈতিক মনোবল ও লড়াকু চেতনা জাগ্রত করতে সাংস্কৃতিক প্রতীক ও লড়াকু চেতনা পরম্পরার অন্তর্গত শক্তি উদ্দীপনা জাগাতে ভূমিকা রাখতে পারে। 

আমাদের সাংস্কৃতিক বিকাশে প্রধান বাধা উপনিবেশিক ব্যবস্থার মধ্যে নিহিত। ব্রিটিশ রচিত ঔপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো বহাল রেখে পাকিস্তানের উঠতি পুঁজিবাদী গোষ্ঠী বিশেষ করে বেসামরিক আমলা গোষ্ঠী এই অঞ্চলের জনগণের উপর বিমাতাসুলভ আচরণ এবং শোষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছিল। এদেরই রক্ষাকর্তা হিসেবে আসীন ছিল ফৌজি শক্তি। যার ফলে এই অঞ্চল থেকে যায় অনগ্রসর, অবহেলিত এবং নিপীড়িত। নিগৃহীত জনগণের অভাব-অনটন, হতাশা ও বিক্ষোভ ক্রমশই পুঞ্জীভূত হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে ধুমায়িত হতে হতে ১৯৭১ সনে একটি প্রবল আগ্নেয়গিরির মতই উদগীরণ ঘটে। এই উদগীরণই পরবর্তীতে স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়। ১৯৭১ সনের স্বাধীনতা সংগ্রাম বাঙালি জাতির ধারাবাহিক মুক্তি আন্দোলনের অচ্ছেদ্য স্বতঃস্ফূর্ত এবং সক্রিয় রূপ। 

পূর্ববঙ্গের মানুষ সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই ইতিহাসের সিঁড়ি ডিঙিয়েছে। অথচ ইতিহাসের সাক্ষ্য, আমাদের যোদ্ধারা কখনও তাদের সম্মান পায়নি। উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামীরা অনেকেই বিস্মৃত। জাতীয়ভাবেও তাদের স্মরণে যথাযথ ব্যবস্থা নেই। আবার সম্মান জানানোর ক্ষেত্রেও রয়েছে বিশেষ বাছবিচার, ছাকুনি। তাই সমাজে তাদের মূল্যায়ন ও প্রভাব নেই। তাদের নিয়ে বিতর্কেরও কমতি নেই। আমাদের সমজে মুক্তিযোদ্ধারা এমন নাজুক অবস্থায় রয়েছে যে, প্রায়শই তাদের পুনর্বাসন করার বিষয়টি সামনে চলে আসে। মুক্তিযুদ্ধের এক সেক্টর কমান্ডের কথা উল্লেখ্যযোগ্য,  “যে জাতির যোদ্ধারাই পুনর্বাসনের স্তরে নেমে যায়, সে জাতির পুনর্গঠন তো দূরে থাক, তাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বই হয়ে পড়ে বিপন্ন।”  ‘ভেতো’ এবং ‘ভীতু’ হিসেবে পরিচিত বাঙালি অতীতের সকল অপবাদ ঝেড়ে-মুছে ফেলে একটি সক্ষম যোদ্ধা জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। রক্তক্ষয়ী বীরত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ ও জাতি এই গৌরবের আসন অধিকার করেছে। এ গৌরবের অংশীদার সমগ্র ও সব জাতি।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, আমাদের যোদ্ধা কারা? লড়াকু সংস্কৃতিই বা কোথায়? 

আমাদের যোদ্ধারা হলেন প্রধানত কৃষক। কৃষক সমাজের মধ্যে বহমান সংগ্রামী চেতনাই আমাদের লড়াকু সংস্কৃতি। আবহমানকাল থেকেই কৃষক প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেছে, সমাজের উম্মূল আধিপত্য শ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। আমাদের এই মাতৃভূমি হাজার বছর ধরে কৃষকের সংগ্রামের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে। অথচ তারা বারবার মার খেয়েছে, তাদের পদানত করে রাখা হয়েছে, তাদের উৎপাদিত পণ্য থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। তারা ব্রিটিশ আমলে অত্যাচারিত হয়েছে, পাকিস্তান আমলে নির্যাতিত হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশেও বঞ্চনার ইতি ঘটেনি। তবুও, সভ্যতার নিয়ন্তা হিসাবে প্রতিরোধী ধারাকে অব্যাহত রেখেছে শ্রমজীবী শ্রেণির (কৃষক ও প্রলেতারিয়েত) মানুষেরা। এটা আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার অপরাপর উপনিবেশবিরোধী দেশের আন্দোলনের মতো বাংলাদেশের বেলায়ও সত্য। ব্রিটিশ আমল তো বটে, তার আগেও অগণিত সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে মৃত্তিকাসংলগ্ন বীর কৃষকের নেতৃত্বে ও অংশগ্রহণে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ১৭৬০-১৯৪৭ পর্যন্ত বাংলায় প্রায় ১৮০টি কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল বলে জানা যায়। এমনকি ইংরেজ আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রথম প্রত্যক্ষ প্রতিরোধ মুসলমান উলেমা সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে এলেও, নেপথ্যে শক্তি জুগিয়েছিল কিন্তু কৃষক সমাজই।

বাংলাদেশের কৃষকের হাজার বছরের সংগ্রামী চেতনাকে আমরা সুষ্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করি শিল্পী এসএম সুলতানের চিত্রকলার মাঝে। সুলতানের ভাষায়, ‘কৃষকই আমাদের বন্দনার মানুষ। ...আমাদের সভ্যতার নির্মাতা তো কৃষকেরা। আমি কৃষককে বড়ো আর্টিস্ট মনে করি। কৃষকই প্রথম শিল্পী। নির্মাণের অভিজ্ঞতা, ফসল ফলানো বা ফসলের আবিষ্কারক কৃষক।’  তাই তিনি বাস্তবে ন্যুব্জ, হতদরিদ্র ও কঙ্কালসার যে কৃষক তার বিপরীতে চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে এঁকেছেন বলিষ্ঠ মানুষজন। সুলতান দৃশ্যমান বাস্তবতা থেকে সরে গিয়ে কৃষকের অন্তর্গত শক্তি ও সংগ্রামী সত্তাকে পেশীবহুল রূপে উপস্থাপন করেছেন। এভাবে কৃষকের হাজার বছরের শক্তি তথা তাদের  আন্তর্শক্তি প্রতীকীভাবে অতিরঞ্জন করে দেখিয়েছেন। তাদের কর্মের উপলব্ধিটাকে বড় করে দেখিয়েছেন। সুলতান আরও বলেন, “কৃষকের মুখে বলিরেখা পড়েছে ঠিকই, কিন্তু চোখের মধ্যে একটা অন্যরকম আগুন আছে।” কৃষকের চোখ থেকে ঠিকরে পড়া এই আগুনই আমাদের সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গ, লড়াকু সংস্কৃতির অস্ত্র-মন্ত্র।

আবার কাজী নজরুল ইসলাম যে ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত সেটা বাংলাদেশের সত্যিকারের উপনিবেশবিরোধী ধারণা। তিনি এক জায়গায় বলেছেন, “তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন, জয় দেখিয়ে নয়।” ... আবার অগ্রপথিক কবিতায় বলছেন, “আয়ারল্যান্ড আরব মিশর কোরিয়া চীন, এক লগে বক্ষে সবার ... এক বেদনার কমরেড মোরা ভাই।” এখানে ‘কমরেড’ শব্দটির ব্যবহার কমুনিস্ট হিসাবে নয়, কমরেড মানে হামদর্দ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী পত্রিকা বের করেছিলেন কমরেড নামে, এটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর নাম দিয়েছেন হামদর্দ। হাম মানে সঙ্গী, দর্দ মানে ব্যথা। মানে বেদনা, সমব্যাথি হওয়াই হল কমরেড। এটাকেই নজরুল বলেছেন, এক বেদনার কমরেড মোরা ভাই সবাই। কমরেড হতে হলে বেদনা লাগে। অপরের বেদনা অনুভব করতে হয়। অন্যথায় কেউ কমরেড হয় না। আর এ বেদনা হল যৌথ বেদনা। এটা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে যৌথ বেদনা ছাড়া কোর্তা পড়ে কমরেড হওয়ার প্রথা চালু হয়েছিল। তাই এই কমরেড, কমরেড হয় নাই। মাওলানা মোহাম্মদ আলী যে কমরেড নাম দিয়েছিলেন, সেটা ছিল এন্টিকলোনিয়াল মুভমেন্ট। তখন, সাংগঠনিকভাবে তারা এটা করেছেন।

যুগে যুগে আমার অনেক যোদ্ধা পেয়েছি, কিন্তু আদর্শ ও দর্শনের শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কোনো সংগঠন পাইনি। তাই আমাদের সংগ্রামের পূর্ণ ফসল ঘরে তোলা সম্ভব হয়নি, বিপ্লব বারবার লক্ষচ্যুত হয়েছে, বেহাত হয়েছে; তবে এটাও সত্য, আমাদের লড়াকু সংস্কৃতি, সংগ্রামী চেতনাবোধ রয়েছে। এগুলো আমাদের জন্য শক্ত ভিত নির্মান করে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের সামনে এদের তুলে ধরা সময়ের দাবি। একই সঙ্গে প্রয়োজন একটি দার্শনিক ভিত্তি, কারণ স্বতঃস্ফূর্ত কোন লড়াই শেষাবধি স্থায়িত্বশীল হয় না। 

৫.

সমাজে লড়াকু সংস্কৃতি বিদ্যমান থাকার অর্থ হল লড়িয়ে মানুষের উপস্থিতি। সংস্কৃতি একটি চলিষ্ণু প্রত্যয়। বদ্ধ ও স্থবির সংস্কৃতি সমাজের সুষ্ঠুতার জন্য অনিষ্টকর। সংস্কৃতি একইসঙ্গে সম্পদ ও দুর্ভোগ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সুষ্ঠু সংস্কৃতি লোকসমাজের বিকাশে তাৎপর্যময় ভূমিকা রাখে। আবার সংস্কৃতি লোকসমাজের অসুস্থতার বীজাণু হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। সংস্কৃতির মধ্যে ইতি-নেতি দুইই রয়েছে। বুর্জোয়া আধিপত্যশীল ও প্রতিক্রিয়া গোষ্ঠি সংস্কৃতির অপব্যবহারের মাধ্যমে শাসন বজায় রাখার প্রয়াস চালায়। সমাজে অনেক কুসংস্কার ও কুপম-ুকতাকে অনেক সময় সংস্কৃতি অভিধায় মহিমান্বিত করা হয়। আবার সংস্কৃতির মাধ্যমে সৃষ্টি করা লোকসমাজের নানা প্রকোষ্ঠ, সংস্কৃতির আদান-প্রদান পথটি করা হয় রুদ্ধ। কখনো সংস্কৃতিকে কঠোর বিধি-বিধানে আবদ্ধ করা হয়, যা অপর সংস্কৃতির প্রতি বৈরগ্রস্ত থাকে। এভাবে সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন সংস্কৃতি মানসিক ও বৈষয়িক উৎকর্ষ সাধনের পথে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। 

একটি লোকসমাজে একই সঙ্গে একাধিক সংস্কৃতি থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে লেনিনের মন্তব্য স্মরণীয়, “শোষণভিত্তিক সমাজে প্রত্যেকটি জাতীয় সংস্কৃতিতে থাকে দুটো সংস্কৃতি: শাসক শ্রেণীর বুর্জোয়া সংস্কৃতি এবং নিপীড়িত মানুষের স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গণতান্ত্রিক আর সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান।” এই অবস্থায় একটি জাতীয় বোধ (হধঃরড়হধষ রিষষ) কিভাবে তৈরি হতে পারে? মানুষের যে কোনো যৌথ বোধে  একটি আবশ্যিক শর্ত হল সংস্কৃতির সৃষ্টি এবং সক্রিয়তা। এ শর্ত প্রতিপালনে সমাজের সক্ষমতা একটি বিষয় বটে।

ইতালিয় কম্যুনিস্ট নেতা ও সাংস্কৃতিক চিন্তক আন্তেনিও গ্রামসি মনে করেন, সমাজের কাঠামো ও উপরিকাঠামোর মধ্যে একটা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিদ্যমান। একে অপরকে প্রভাবিত করে। আর এই দুইয়ে মিলে গঠন করে একটি ঐতিহাসিক ব্লক। অর্থাৎ পূর্ববর্তী সমাজের স্থলে আমূল রূপান্তরিত আরেকটি সমাজের সূচনা ঘটে। তার এই ভাবনাটি ছিল সমাজতান্ত্রিক চিন্তার ক্ষেত্রে অভিনব একটি উদ্ভাবন। আগে ধারণা করা হতো কাঠামো, মানে অর্থনীতি তথা সমাজের উৎপাদন-সম্পর্ক সমষ্টি অর্থাৎ উৎপাদন, বিনিময় আর বন্টনের ক্ষেত্রের সম্পর্কগুলোর সমষ্টি উপরিকাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে। সমাজের কাঠামো বা বনিয়াদ থেকে আসে সমাজের সব সামাজিক সম্পর্ক, ভাব-ভাবনা, বাসনা ও বিশ্ববীক্ষা। এভাবে কাঠামো ও উপরিকাঠামোর মধ্যে যে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত থাকে, সেখানে প্রথমোক্তটি সক্রিয়, শেষোক্তটি নিষ্ক্রিয়। এ দাবিটি গ্রামসি অগ্রাহ্য করেন। তিনি সমাজের অর্থনীতি সম্পর্কের প্রভাবকে গভীরভাবে গ্রাহ্য করেন, একইসঙ্গে মনে করেন সমাজ বিপ্লব ও রূপান্তরে উপরিকাঠামো, বিশেষভাবে সংস্কৃতির একটি সক্রিয় তাৎপর্যময় ভূমিকা রয়েছে।

গ্রামসি সমাজ রূপান্তরের দায়িত্বটি শ্রমিক শ্রেণির ওপর আরোপ করেন। তার মতে, শ্রমিক শ্রেণির প্রথম কাজ হলো, বুঁর্জোয়া শ্রেণির নেতৃত্বে পরিচালিত বিদ্যমান ঐতিহাসিক ব্লকের বদলে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ব্লক সৃষ্টি করা। আর এই লক্ষ্যে পৌঁছানো এককভাবে শুধু শ্রমিক শ্রেণির পক্ষে যে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়, এ বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন। তাই তিনি অপরাপর শ্রেণি, এমনকি বুঁর্জোয়া-পাতিবুঁর্জোয়াভুক্ত শ্রেণির সমগ্র তৈরিতে সম্মতি জানান। তবে শর্ত থাকে যে, এ সম্মতি বা সমগ্র সৃষ্টি হবে শ্রমিক শ্রেণির আধিপত্য বজায় রেখে। তাই তিনি বিভিন্ন শ্রেণির সঙ্গে ব্যাপক মৈত্রীবন্ধনের ভিত্তিতে একটি জাতীয়-লোকায়ত বোধ (হধঃরড়হধষ-ঢ়ড়ঢ়ঁষধৎ রিষষ) গড়ার পক্ষপাতী ছিলেন। এ কাজে সফলতা অর্জনে দুদিক থেকে সমর্থন দরকার পড়ে। একদিকে প্রলেতারিয়েত শ্রেণিÑ কৃষক, শ্রমিক ও নি¤œবর্গীয় মানুষ, আরেকদিকে মাঝারি ও ছোট স্তরের বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন। এসব বুদ্ধিজীবীদের ওপর আধিপত্য জারি রেখে সগোত্রভুক্ত করার মাধ্যমে নিজস্ব জৈব বুদ্ধিজীবী গড়ে তুলতে হবে। বিপুল কৃষক সমাজকে অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলতে হবে। বুদ্ধিজীবীদের দলভুক্ত করতে হবে এজন্য যে, তারা কাঠামো ও উপরিকাঠামোর মধ্যে সংযোগ রক্ষায় ভূমিকা রাখে। উপরন্তু এই ঘরানার বুদ্ধিজীবী জাতীয় জনগণের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সচেতনÑ যারা নিজেদের লাঞ্ছিত-বঞ্চিত মানুষের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে। এভাবে গড়ে তোলা সম্ভব একটি বৃহত্তর ও আধিপত্যশীল মৈত্রীবন্ধন। এই মৈত্রী সমাজের নয়া রপান্তর তথা নয়া ঐতিহাসিক ব্লক গঠন করবে।

বিশ্বসংস্কৃতি যেমন জাতীয় সংস্কৃতির সমগ্র বলে বিবেচিত, তেমনি জাতীয় সংস্কৃতি লোকায়ত সংস্কৃতির সমগ্র বলে বিবেচিত। লোকায়ত সংস্কৃতির সমগ্রের জোটের মাধ্যমেই জাতীয় সংস্কৃতি তথা সংহতি গড়ে তোলা আবশ্যক। জাতীয় সংস্কৃতির নামে কোন বিশেষ সুবিধগোষ্ঠির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা অনভিপ্রেত। এর ব্যত্যয়ে সমাজে সাংস্কৃতিক বিভেদ স্পষ্টতর হয়। যেটা আমাদের সমাজের দৃঢ়মূল হয়ে আছে। 

আধিপত্যশীল এলিট ও বুঁর্জোয়া সংস্কৃতির সঙ্গে বৃহত্তর জনগোষ্ঠির বিচ্ছেদ এখানে চোখে পড়ার মতো। ফলে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও জাতীয় পর্যায়ে যৌথ বোধ গড়ে উঠছে না। আমাদের মূলধারার বুদ্ধিজীবীদের ভাষা ও শাসকশ্রেণির মনোভঙ্গি বিস্তীর্ণ গ্রামীণ প্রান্তরে দূরবর্তী বার্তাবহ। অন্যদিকে নি¤œবর্গীয় ও প্রান্তীয় সংস্কৃতি আধিপত্যশীল ও মার্গীয় সংস্কৃতির কাছে অপাঙক্তেয়। কখনো বা বিনোদনের উপলক্ষ। এ বিষয়টি সমাজ-সংস্কৃতি বিকাশের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে।

আমাদের সমাজের জন্য একটি সাংস্কৃতিক লড়াই অনিবার্য হয়ে পড়েছে। সর্বদা লড়াই জারি রাখতে হবে। এ লড়াইয়ে প্রধানতম লক্ষ্য হবে একটি জাতীয়-লোকায়ত বোধ গড়ে তোলা। 

 
 
[ প্রবন্ধটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অনুষ্ঠিত বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসবে ১০ জানুয়ারি ২০১৬-এ সেমিনার পেপার হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছিল। প্রবন্ধটির নিয়ে পর্যালোচনা করেন ড. পবিত্র সরকার (ভারত), অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ, মফিদুল হক, খালেদ হোসাইন, ড. রফিকুল্লাহ খান ও ড. শ্যামলকান্তি সরকার (ভারত) ]

1 comment:

  1. একবার পরলাম প্রিন্ট করে রেখেছি আবার ও পরা দরকার

    ReplyDelete