মোহাম্মদ আজম
ব্যক্তিগত চর্চায় এবং সাহিত্যসাধনায় ইলিয়াস তাঁর ভাঁড়ারে এমন সব উপকরণের সংযোগ ঘটাতে পেরেছিলেন, যেগুলো আমাদের জন্য লাভজনক হয়েছে। জনসংস্কৃতি মঞ্চ যে শিরোনাম ঠিক করেছে Ñ ‘সংস্কৃতির লড়াই ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস’ Ñ তা আমার কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও সংস্কৃতির লড়াই’ও হতে পারত। এবং সেক্ষেত্রেও সম্ভবত তাৎপর্য একই থাকত। আজকাল তাৎপর্যহীনভাবে ব্যক্তি-বন্দনার যে রেওয়াজ আমাদের চারপাশে দেখতে পাই, সেরকম অর্থহীন কোনো বাগাড়ম্বর হয়ে উঠত না। কারণ ইলিয়াস খুব নির্দিষ্টভাবে সংস্কৃতির লড়াইয়ে শামিল ছিলেন। আমরা যারা নিজেদের বর্তমান বাস্তবতা ও বর্তমান লড়াই-সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে আমাদের বিগত কৃতী ব্যক্তিদের পড়তে চাই এবং ব্যবহার করতে চাই, তাদের কাছে সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সামনে চলে আসেন। হয়ত শিরোনামটি হতে পারত ‘জনসংস্কৃতির লড়াই ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস’। বলা যেত জনসংস্কৃতির পক্ষের লড়াই। সংস্কৃতি যদিও গভীরতর অর্থে জনসংস্কৃতিই, তবুও বিদ্যমান বাগাড়ম্বতায় Ñ মধ্যবিত্তের জনবিচ্ছিন্ন সংস্কৃতির প্রবল প্রতাপের বাস্তবতায় Ñ ‘সংস্কৃতি’ শব্দটার বদলে ‘জনসংস্কৃতি’ই ব্যবহার করা দরকার। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য, অর্থাৎ ‘সংস্কৃতি’ শব্দটাকে জনমানুষের অধিকারে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি বহুমাত্রিক লড়াই। বলা দরকার, এ ধরনের লড়াইয়ে ব্যক্তি ও সাহিত্যিক ইলিয়াস একজন যোগ্য সহযাত্রী।
ব্যক্তিগত চর্চায় এবং সাহিত্যসাধনায় ইলিয়াস তাঁর ভাঁড়ারে এমন সব উপকরণের সংযোগ ঘটাতে পেরেছিলেন, যেগুলো আমাদের জন্য লাভজনক হয়েছে। জনসংস্কৃতি মঞ্চ যে শিরোনাম ঠিক করেছে Ñ ‘সংস্কৃতির লড়াই ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস’ Ñ তা আমার কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও সংস্কৃতির লড়াই’ও হতে পারত। এবং সেক্ষেত্রেও সম্ভবত তাৎপর্য একই থাকত। আজকাল তাৎপর্যহীনভাবে ব্যক্তি-বন্দনার যে রেওয়াজ আমাদের চারপাশে দেখতে পাই, সেরকম অর্থহীন কোনো বাগাড়ম্বর হয়ে উঠত না। কারণ ইলিয়াস খুব নির্দিষ্টভাবে সংস্কৃতির লড়াইয়ে শামিল ছিলেন। আমরা যারা নিজেদের বর্তমান বাস্তবতা ও বর্তমান লড়াই-সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে আমাদের বিগত কৃতী ব্যক্তিদের পড়তে চাই এবং ব্যবহার করতে চাই, তাদের কাছে সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সামনে চলে আসেন। হয়ত শিরোনামটি হতে পারত ‘জনসংস্কৃতির লড়াই ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস’। বলা যেত জনসংস্কৃতির পক্ষের লড়াই। সংস্কৃতি যদিও গভীরতর অর্থে জনসংস্কৃতিই, তবুও বিদ্যমান বাগাড়ম্বতায় Ñ মধ্যবিত্তের জনবিচ্ছিন্ন সংস্কৃতির প্রবল প্রতাপের বাস্তবতায় Ñ ‘সংস্কৃতি’ শব্দটার বদলে ‘জনসংস্কৃতি’ই ব্যবহার করা দরকার। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য, অর্থাৎ ‘সংস্কৃতি’ শব্দটাকে জনমানুষের অধিকারে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি বহুমাত্রিক লড়াই। বলা দরকার, এ ধরনের লড়াইয়ে ব্যক্তি ও সাহিত্যিক ইলিয়াস একজন যোগ্য সহযাত্রী।
সংস্কৃতির ধারণাটি একটি অত্যন্ত ব্যাপক ধারণা। এটি শ্রেণীর ব্যাপার। উচ্চশ্রেণী ও নিম্নশ্রেণীর সংস্কৃতির লড়াইয়ের ব্যাপার তো বটেই; একই সঙ্গে শহুরে ও গ্রামীণ সংস্কৃতি আছে, শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের সংস্কৃতি আছে। যেমন ধরা যাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক এক ধরনের সংস্কৃতি আছে Ñ যার অধীনে আমরা সভা-সেমিনার করে বেড়াই Ñ এবং বস্তিবাসীর সংস্কৃতি আছে। এসব বিশিষ্ট সংস্কৃতির বিশেষ মাত্রার মধ্যে প্রতিনিয়ত লড়াই চলছে। কিন্তু আজকে একটি লড়াইয়ের কথা বিশেষভাবে আমি বলতে চাই। সম্ভবত সজ্ঞানে সজোরে আমাদের সেই লড়াইয়ে অংশ নেয়া দরকার। সেটা হচ্ছে ক্ষমতাবলয়ভুক্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংকীর্ণ এবং জনবিচ্ছিন্ন সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই। এর উপস্থিতি এবং দাপট আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত লক্ষ করছি। ব্যাপারটা বোঝানোর জন্য আমি একটা উদাহরণ দেই। গত দশ-পনের বছর ধরে খেয়াল করেছি, এফডিসিকেন্দ্রিক বাংলা সিনেমার বিরুদ্ধে একটা প্রপাগান্ডা চলছে। ঢাকাই সিনেমায় অশ্লীলতার ব্যাপারটা সত্য কি অসত্য Ñ তা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা চলতেই পারে। কিন্তু অশ্লীল সিনেমা এবং আরও নানান ধরনের অজুহাতে এই সিনেমাকে ক্রমশ কোণঠাসা করে ড্রইংরুম-নির্ভর এবং তথাকথিত ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার শো-এর উপর ভর করা এক ধরনের জনবিচ্ছিন্ন সিনেমা-সংস্কৃতি আমরা ঢাকায় লক্ষ করছি। একে আমরা বলতে পারি জনবিচ্ছিন্ন মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির একটা দৃষ্টান্ত। ইলিয়াস তাঁর জীবন ও সাহিত্যে এই ধরনের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রচারণা করেছেন, সংগ্রাম করেছেন । ফলে জনসংস্কৃতির পক্ষে আমাদের নিজেদের যে লড়াই Ñ যদি কোনো লড়াই আদৌ থেকে থাকে, বা যদি আমরা এ ধরনের কোনো লড়াইয়ে নিরত হতে চাই Ñ তার জন্য তাঁর পঠন-পাঠন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও মনে রাখা ভালো, ইলিয়াসকে শেষ পর্যন্ত আমরা পুরোপুরি ‘গণলেখক’ বা জনগণের শিল্পী বলতে পারব না। তাঁর সাহিত্যকর্মের বড় অংশই এলিট শিল্পভোক্তাদের মেজাজ, রুচি ও চাহিদার অনুকূলে বিন্যস্ত। কিন্তু ঢাকার সাহিত্যের বিশেষ বাস্তবতায় আর গত কয়েক দশকের চর্চার ইতিহাসের মধ্যে জনচৈতন্য ও জনমানস আবিষ্কারের ক্ষেত্রে ইলিয়াসের প্রয়াস ও সাফল্য জনগণের পক্ষের লড়াইয়ে তাঁর কর্মকা-কে একটা বিশিষ্টতা দিয়েছে।
এই বিশিষ্টতাকে বুঝতে হলে ঢাকার সাহিত্যের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দিকে আমাদের নজর দেয়া দরকার। আমি সে প্রসঙ্গে প্রথমে কথা বলব। ইদানীং আমার মনে হচ্ছে, ঢাকার সাহিত্য মূলত শিক্ষিত লোকদের সাহিত্য, তথা শিক্ষিত সাহিত্যিকদের সাহিত্য। ‘শিক্ষিত’ শব্দটাকে একটা ক্যাটাগরি আকারে ব্যবহার করছি আমি; এর বিপরীতে আর একটা ক্যাটাগরির কথা বলতে পারি। বোঝার সুবিধার্থে একে বলতে পারি জাত সাহিত্যিক কিংবা ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক সাহিত্যিক। এবং যাকে আমি জাত বা ন্যাচারাল সাহিত্যিক বলছি তার উদাহরণ হিসাবে হুমায়ুন আহমেদের উল্লেখ করতে চাই। এটা ঠিক ‘জনপ্রিয়তা’র মামলা নয়। ইমদাদুল হক মিলন বা মইনুল আহসান সাবেরকে এই তালিকায় আনব না। বরং শামসুর রাহমান কিংবা আল মাহমুদকে অনেকদূর পর্যন্ত এই অর্থে ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক সাহিত্যিক বলতে পারি। শিক্ষিত সাহিত্যিক বলতে আমি বুঝাচ্ছি তাঁদের, যাঁরা লেখাপড়া শিখেছেন ইংরেজি কিংবা অন্য নানান মাধ্যমে। তাঁরা জ্ঞানার্জন করেছেন, পড়েছেন, মানুষের জীবন-জগৎ ইত্যাদি সম্পর্কে একটা পূর্ব-ধারণা অর্জন করেছেন এবং তারপর লিখেছেন। খুব সরলভাবে বলতে পারি, লেখকের দিক থেকে এটি একটি অবরোহ পন্থা। অর্থাৎ জীবন সম্পর্কে একটা ধারণা বা ছক আগে থেকেই স্থির করে নিয়ে সেটার ভিত্তিতে তাঁরা নিচের দিকে তাকিয়েছেন। সম্ভবত এ কারণেই Ñ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি Ñ ঢাকার সাহিত্যিকদের লেখায় আমাদের জনজীবন সম্পর্কে, মানুষ সম্পর্কে যে ধরনের ছবি আমরা দেখতে পাই, চারপাশে সাদা চোখে তাকিয়ে আমি অন্তত তার সঙ্গে জীবনের বিশেষ মিল খুঁজে পাই না।
দেবেশ রায় উপন্যাস নিয়ে লিখিত তাঁর একটি বিখ্যাত প্রবন্ধে লিখেছিলেন, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে অল্প কয়েক বছরের ব্যবধানে বাংলা সাহিত্যে অন্তত দুইবার আধুনিকতার আবির্ভাব ঘটেছিল। কবিতা এবং উপন্যাস Ñ দুই জায়গা থেকেই তিনি এই দৃষ্টান্ত দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন ঈশ্বরগুপ্তের হাতে একবার আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটেছে কবিতায় এবং অনতিবিলম্বে আরেকবার ঘটেছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতার মধ্যে। উপন্যাসে একবার ঘটেছে প্যারীচাঁদ মিত্রের মধ্যে এবং তার অল্প কিছুদিন পরে Ñ সাত-আট বছরের মধ্যেই Ñ আরেকবার হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে। তাঁর মতে প্রথম আধুনিকতা ছিল নতুন সময়ের আধুনিকতা। তখনো ঔপনিবেশিক শক্তি কিংবা উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়া তখনকার কলকাতার সমাজে খুব জেঁকে বসেনি। কিন্তু আধুনিকতার পরবর্তী পর্বে উচ্চাঙ্গের লেখক মাইকেল মধুসূদন দত্ত কিংবা বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে আমরা লেখক এবং পাঠক তথা দাতা এবং গ্রহিতা দুই পক্ষ থেকেই উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়া গভীরভাবে জেঁকে বসার খবর পাই। এই উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার ফলে যে জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে তাদের জন্য আবির্ভূত হয়েছে দ্বিতীয় আধুনিকতা। উনিশ শতকের শেষার্ধে ইংরেজি শিক্ষা, সরকারি চাকুরি, জমিদারি, সওদাগরি অফিসের উপার্জন ইত্যাদি মিলে তৈরি হয়েছিল যে ছোট্ট জনবিচ্ছিন্ন উচ্চশ্রেণীটি Ñ দেবেশ রায় বিস্তারিতভাবে দেখিয়েছেন Ñ বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় আধুনিকতার লেখক-পাঠক দুই পক্ষই সেই উচ্চশ্রেণীর উপজাত মাত্র।
এই সূত্রে আমরা যদি আরও অগ্রসর হই তাহলে দেখতে পাব, ১৯৩০-এর দশকে আমাদের সাহিত্যে তৃতীয় আধুনিকতার আবির্ভাব ঘটেছে। এই তৃতীয় আধুনিকতার সঙ্গে আগেরটির একটা বড় পার্থক্য রয়েছে। আগের আধুনিকতা সীমাবদ্ধ হলেও, প্রধানত জাতীয়তাবাদী প্রকল্প থাকার কারণে, একটা জনগোষ্ঠীর জীবনের সঙ্গে খানিকটা যোগ ছিল বিধায় জনমানুষের কাছে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে পৌঁছবার চেষ্টা এর মধ্যে পাই। কিন্তু, ত্রিশের আধুনিকতা Ñ আমরা দেখব Ñ ব্যাপকভাবে জনবিচ্ছিন্ন এবং সংকীর্ণ। জনগণের কাছে পৌঁছানোর তুলনায় লেখকদের কেউ কেউ ঘোষিতভাবে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াকে কৃতিত্বপূর্ণ ব্যাপার বলে মনে করতেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যদি বিচার করি তাহলে দেখব, ঢাকার সাহিত্যের অবস্থা আরো শোচনীয়। আমাদের এখানে আমরা সাধারণভাবে ধরে নিই ষাটের দশকে এক ধরনের আধুনিকতাবাদের চর্চা হয়েছিল। সেই চৈতন্যের মধ্যে আমরা পূর্বতন আধুনিকতাবাদগুলোর যাবতীয় বৈশিষ্ট্য তো দেখবই, সাথে আরো যুক্ত হয়েছে কলকাতাকেন্দ্রিক ভাবপ্রবাহের একটা প্রকা- চাপ। এবং সম্ভবত এসব কারণেই আমাদের অনেক লেখক বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দিকে সাদা চোখে তাকাতেই পারেননি। আমি দুটো উদাহরণ দিচ্ছি। সৈয়দ শামসুল হক ষাটের দশকে লেখা একটি উপন্যাসে এক তরুণীর সমস্যা নিয়ে কাহিনি ফেঁদেছেন। এই তরুণীর সমস্যা হল, তিনি গর্ভধারণ করবেন তার স্বামীর দ্বারা নাকি তার বন্ধুর দ্বারা। এই নিয়ে তিনি উপন্যাসটি লিখেছেন। আমি নিশ্চিত, ২০০৮ সালেও এটা ঢাকার সমাজের কোনো প্রতিনিধিত্বশীল সংকট নয়। সৈয়দ শামসুল হক ষাটের দশকে ঢাকার চরিত্রের মধ্যে এ ধরনের সমস্যা আরোপ করে একটি নয়, অনেক লেখালেখি করেছেন। আরেকটি উদাহরণ দিই। মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন। ঢাকার সাহিত্যে এটি একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। নিশ্চয়ই এর অনেক গুরুত্ব ও তাৎপর্য আছে। কিন্তু এই উপন্যাসের খোকা চরিত্রটি যদি আমরা লক্ষ করি, স্বাধীনতার পূর্ববর্তী অবস্থায় যখন পুরো জনগোষ্ঠী একটি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, তার রাজনৈতিক এবং ভাববলয়ে ঐ প্রস্তুতি যখন দানা বাঁধছে, তখন খোকা চারপাশের ঘটনাবলিকে যেভাবে দেখছে এবং যে নিরাসক্ত বিচ্ছিন্ন অবস্থায় নিজের অবস্থানকে বজায় রাখছে, এই ব্যাপারটিকে কিছুতেই ঢাকার রাজনৈতিক বা সমকালীন বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই এই লেখকদের এবং অন্য লেখকেরও কিছু ব্যতিক্রমী প্রয়াস আছে। এবং এই লেখকবলয়ের বাইরে আরো লেখক আছেন। আহমদ ছফার নাম বলতে পারি কিংবা আরো কারো কারো। কিন্তু ঢাকার সাহিত্যের প্রধান যে প্রবাহ, তাকে আমরা ঐ জনবিচ্ছিন্ন আধুনিকতার আবহের মধ্যেই পাব, পাব বাস্তবতার রিক্ততার মধ্যে। ইলিয়াসকে এই বাস্তবতায় বিচার করলে দেখব, ইলিয়াস এই প্রেক্ষাপটেই কলম ধরেছিলেন। আমাদের ভুলে যাওয়ার কোনো কারণ নাই, ঐ সময়ের রচনার যে বৈশিষ্ট্যের কথা আমি বললাম, অন্তত দুই দশক পর্যন্ত ইলিয়াসের রচনায় তার সবটাই ছিল। তিনি প্রচ-ভাবে আধুনিকতাবাদী ছিলেন, এবং আধুনিকতাবাদের যে বিচ্ছিন্নতা, মর্বিডিটি, ক্ষয়িষ্ণু মানসিকতা তার সবটাকে পরম মূল্য দিয়েই তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন।
মানুষের পরিচয় দিতে গিয়ে পেটের ক্ষুধার তুলনায় যৌন ক্ষুধাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন Ñ তাঁর কোনো কোনো গল্পে এরকমটা দুর্লক্ষ নয়। পরে তিনি এই ব্যাপারটিকে অনেকদূর পর্যন্ত অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। একটা কথা বলে রাখি, যে বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা আগে বলেছি সেগুলো যে অন্তর্নিহিতভাবে খারাপ তা নয়। খুব চমৎকার সাহিত্য তাতে হতে পারে এবং সারা পৃথিবীতে বুর্জোয়া সাহিত্যের একটা বড় অংশ এইসব নিয়েই হয়েছে। কিন্তু আমরা যদি জনসম্পৃক্ততার কথা বলি, সংস্কৃতির যে লড়াই প্রতিনিয়ত চলছে তার কথা বলি, তার সঙ্গে একজন লেখকের একাত্মতা পোষণের কথা বলি, তাহলে নিশ্চয়ই এর উল্টোদিকটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যেদিকটায় আমার বিবেচনায় ইলিয়াস পরবর্তী জীবনে অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হতে পেরেছেন।
ইলিয়াসের কয়েকটি সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্যের কথা এবং তাঁর জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ের উল্লেখ আমি করতে চাই, যেগুলো তাঁকে এই রূপান্তরে সাহায্য করেছিল। যেমন ইলিয়াসের একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্যের কথা আমি বলব Ñ তাঁর ‘গভীর বাস্তববাদিতা’। আমরা প্রায়ই তাঁর সাহিত্যকর্মের ডিটেল্স্ ব্যাখ্যা করার জন্য ফটোগ্রাফিক বাস্তবতার কথা বলে থাকি। এই বাস্তববাদিতা একটি সাহিত্যিক রূপ নিশ্চয়ই। কিন্তু আমরা আন্দাজ করতে পারি, খুব নিখুঁতভাবে পরিপার্শ্বকে, বস্তুকে, মানুষকে এবং মানবিক সম্পর্কগুলোকে যদি উপস্থাপন করতে হয়, একজন লেখককে যদি তাঁর বিষয়ের সঙ্গে সৎ থাকতে হয়, তাহলে তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দিকে গভীরভাবে তাকাতেই হয়। ইলিয়াসকেও তাকাতে হয়েছিল এবং এই তাকানোর ফলে পরবর্তীতে তিনি অপেক্ষাকৃত নিগূঢ়ভাবে মানুষকে চিনতে পেরেছিলেন বলে আমার ধারণা। দ্বিতীয়ত, প্রথম থেকেই ইলিয়াসের মধ্যে একটা শ্রেণীচৈতন্য ছিল। যাকে আমরা গণচৈতন্য বলি শ্রেণীচৈতন্য সব সময় তা নয়। ইলিয়াস নিজেও তাঁর খোয়াবনামা এবং অন্যত্র দেখিয়েছেন যে, সব সময় শ্রেণীরাজনীতি গণমানুষের কাছাকাছি যেতে পারে না। কিন্তু তবুও শ্রেণীচৈতন্যের একটা ভূমিকা তো রয়েছেই। জনগণের লড়াই-সংগ্রাম অনুসরণ করার ক্ষেত্রে কিংবা নিম্নশ্রেণীর মানুষের দিকে সহানুভূতির চোখে তাকানোর ক্ষেত্রে শ্রেণীচেতন একজন সাহিত্যিক নিশ্চয়ই অনেক সুবিধা পেয়ে থাকেন। তৃতীয় একটা বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করি : তিনি তাঁর লেখায় অবলম্বন করেছেন পুরান ঢাকাকে। এটা তাঁকে গণসম্পৃক্ত হতে সাহায্য করেছে এবং এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার মনে হয়। আমি বিশদ আলোচনার যাচ্ছি না। সাহিত্যে যাকে নগরচেতনা বলে তার সাথে মর্ডানিস্ট জীবনবোধ কিংবা বিচ্ছিন্নতা, মর্বিডিটি এগুলোর একটা সম্পর্ক আছে। আমরা জানি, পুরান ঢাকার যে জনজীবন, সেই জীবনের মধ্যে আধুনিকতাবাদ অর্থে নগরচেতনার সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে না। ইলিয়াসকে পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছে পুরান ঢাকার মানুষের জনজীবন, তার সম্পর্ক, পেশা, তার সংলাপ; এমনকি আমরা জানি যে ইলিয়াস পুরান ঢাকার অলিগলির ফটোগ্রাফিক বর্ণনায় তাঁর রচনার বিভিন্ন অংশকে সমৃদ্ধ করেছেন। এই যে একটা বিশেষ জনজীবনকে অবলম্বন করেছেন, এ জন্য তাঁকে বিশেষভাবে দেখতে হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি যে নগরচেতনা পেয়েছেন, শিক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি যে আধুনিকতাবাদের ধারণাগুলো পেয়েছেন, সেগুলোর কোনো কোনোটি তিনি অতিক্রম করতে পেরেছেন বলে মনে হয়। তাঁর প্রজšে§র অন্য অনেক লেখকের মতো নিশ্চয়ই তাঁর ক্ষেত্রেও মুক্তিযুদ্ধ এ পরিবর্তনের বেলায় বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। এই গণযুদ্ধে যে যেভাবেই অংশগ্রহণ করে থাকুক না কেন, এর প্রচ- পীড়ন এবং জনসম্পৃক্ততা নিশ্চয়ই তাঁরা এড়িয়ে যেতে পারেননি। ইলিয়াস মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু লিখতে পারেননি। তবে আমাদের ভুললে চলবে না, তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্পের কয়েকটি মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই লিখিত।
ইলিয়াস ক্রমশ একটি পরিণতির দিকে যাচ্ছিলেন। পরিণতি বলতে জনসংস্কৃতির লড়াইয়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ এবং সেই বিষয়টাকে সাহিত্যে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার যাত্রাকে বোঝাচ্ছি। চিলেকোঠার সেপাই পর্যবেক্ষণ করলে দেখব, সেখানে বামপন্থী কর্মীকে কিংবা রাজনৈতিক কর্মীকে ঢাকার কেন্দ্রীয় ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে স্থান দিতে না পেরে তিনি গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এবং ঢাকার আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি হিসাবে স্থাপন করেছেন বস্তিবাসী হাড্ডি খিজিরকে। সেই ইতিহাস আমরা জানি। হাড্ডি খিজিরের কাছে মধ্যবিত্ত ওসমান এক অর্থে সবদিক থেকে পরাজিত-পরাস্ত হয়েছে। তাকে শিক্ষক মেনেছে এবং শেষ পর্যন্ত ঐ সম্পৃক্ততায় ওসমানের নিজের জগৎ এক অর্থে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। সে বেরিয়ে পড়েছে বাইরে Ñ পথে, মিছিলে, মাঠে-ঘাটে। এই সম্প্রসারণ বা নিজেকে ক্রমশ প্রান্তের দিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা এভাবে একটা চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছে। আমরা দেখব খোয়াবনামায় ইলিয়াস অবলম্বন করলেন সময় এবং ইতিহাসের সেই সব ধারণা, যেগুলো অনেক বেশি পরিমাণে গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষা আর টিকে থাকার ইতিবৃত্ত বুকে নিয়ে রূপায়িত হয়েছে। ঐ যে বলেছিলাম, আমাদের অধিকাংশ লেখকই ‘শিক্ষিত সাহিত্যিক’, এটা খোয়াবনামার ক্ষেত্রেও Ñ আমি বলব Ñ প্রযোজ্য। ইলিয়াস খোয়াবনামায় ইতিহাসপাঠের অনেকগুলো আদল ব্যবহার করেছেন। উপস্থাপনের প্যাটার্নের দিক থেকে মার্কেজের প্রভাব বেশ পড়া যায়। আখ্যান নির্মাণে হয়ত নিম্নবর্গীয় ইতিহাসচর্চার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই যে, ইতিহাস পাঠের ক্ষেত্রে কিংবা চরিত্র উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ইলিয়াস সেই বিষয়গুলোকে অবলম্বন করেছেন, সেই শিক্ষাটাকে অবলম্বন করেছেন, যে শিক্ষাটা অপেক্ষাকৃত অধিকমাত্রায় জনতাকে উপস্থাপন করতে পারে।
অধিপতি শ্রেণীর ইতিহাসের সারশূন্যতা দেখে জনসংস্কৃতির লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন যে ইলিয়াস, সে ইলিয়াসের সাহিত্যকর্মের ভাষা শেষ বিচারে কি পুরোপুরি জনগণের ভাষা? আমি বলব, জনগণের ভাষা নয়। প্রান্তজনের কথা তার ভাঁড়ারে যথেষ্ট আছে, সংলাপ আছে, এবং সংলাপের মধ্য দিয়ে অভাজনদের ফর্ম তিনি তাঁর রচনায় উপস্থাপন করেছেন এবং করতে পেরেছেন। কিন্তু ফর্ম ও ভাষার নিয়ন্ত্রণ তার নিজের হাতেই ছিল। নিজের শিল্পচৈতন্য ও ঐতিহাসিক অবস্থানের শিথিলতার মধ্য দিয়ে প্রান্তজনের ভাষার নতুন চরিত্র তাঁর ফর্মকে তছনছ করে দেয়নি। তা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ইতিহাসপাঠপ্রবণতা এবং ভালো-মন্দের বোধকে প্রান্তজনের নিরিখে তিনি অনবরত পুনঃমূল্যায়ন করেছেন, পুনঃপরীক্ষা করেছেন, পুনর্নির্মাণ করেছেন এবং এর মধ্য দিয়ে তিনি নিজস্ব ধরনে সংগ্রাম করেছেন সংকীর্ণ মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। এ লড়াইয়ে কৃষক-শ্রমিকসহ গরিষ্ঠ জনগণের আকাক্সক্ষার কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছিলেন তিনি।
মধ্যবিত্ত ঘরানার একজন মানুষ হিসেবে আমি নিজে ইলিয়াসের ব্যক্তিগত জীবনও পাঠ করে থাকি। আমরা জানি সংগঠন গড়তে, জানতে-বুঝতে ইলিয়াস ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত। চারপাশের নিষ্ক্রিয় মানুষজনের ভিড়ে, ঢাকার বাকোয়াজি-নির্ভর বুদ্ধিজীবিতার প্রাবল্যের মধ্যেও আমার কাছে ইলিয়াসের এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মূল্য অনেক বেশি। মাঝে মাঝে মনে হয়, তাঁর কালের অনেকে যা পারেননি Ñ নিজেকে ক্রমশ প্রসারিত করে গণমানুষের আবেগ ও মুক্তিসংগ্রামের সন্নিকট হওয়া Ñ ইলিয়াস যে তা অনেকদূর পর্যন্ত পেরেছেন, তার মূল কারণ ব্যক্তিগত তৎপরতা। খোয়াবনামার সাফল্য তাঁর দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক তৎপরতারই ফল। এদিক থেকে আমি বলব, ইলিয়াসের সাহিত্যকর্মের মতো তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতাও আমাদের অবশ্যপাঠ্য। জনসংস্কৃতির পক্ষে আমাদের আরো বেশি জনসম্পৃক্ত হওয়ার যাত্রাপথে ইলিয়াস তাঁর ব্যক্তিগত জীবন এবং সাহিত্যিক অবদানে অতি গুরুত্বপূর্ণ একজন হিসেবে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।
(এ লেখাটি জনসংস্কৃতি মঞ্চ আয়োজিত এক সভায় দেয়া বক্তৃতার লিখিত রূপ। ঐ সভায় কোনো প্রবন্ধ পঠিত না হওয়ায় আলোচনার স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু একটা শিরোনাম নির্ধারিত ছিল বলে স্বভাবতই শিরোনাম মোতাবেক কথাগুলো সাজাতে হয়েছে। প্রবন্ধ-আকারে ছাপানোর কালে সে সজ্জায় বা বক্তব্যে বিশেষ কোনো পরিবর্তন আনিনি; শুধু পড়ার সুবিধার্থে কিছু ভাষাগত পরিমার্জনা করেছি। Ñ মোহাম্মদ আজম)
No comments:
Post a Comment