Friday, April 3, 2015

আপনি যখন অ্যামেরিকায়

চিমানদা নগোজি আদিচি

আপনার ধারণা ছিল অ্যামেরিকাতে সবারই গাড়ি আর বন্দুক থাকে। আপনার কাজিন ও আত্মীয়-স্বজনদেরও তাই ধারণা। অ্যামেরিকার ডিভি লটারি জেতার পরই তারা আপনাকে বলেছিল, ওইখানে একমাসের মধ্যেই তোমার গাড়ি হইবো, তারপর বিরাট বাড়ি কিন্তু ওই আমেরিকানগো মতো আবার বন্দুক কিনতে যাইও না ।

তারা লাওসের বস্তিঘরে আপনার চারপাশে জড়ো হয়ে নোনাধরা পেরেক লাগানো দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাড়িঁয়ে ছিল, কারণ চেয়ারে বসে ইচ্ছেমতো নড়াচড়া করা যায় না, চেচিয়ে বিদায় জানানো যায় না এবং বড় কথা হলো, ফিসফিসিয়ে তাদের  জন্য অ্যামেরিকা থেকে কী কী পাঠাতে হবে তা বলা যায় না। বড়সড় গাড়ি আর বিরাট বাড়ির (এবং  বন্দুকের) কাছে তাদের চাওয়াটা কিছুই নাÑ হাতব্যাগ, জুতার মতো সামান্য জিনিস মাত্র। আপনি বলেছিলেন, ঠিক আছে, কোনো ব্যাপার না ।
অ্যামেরিকাতে আপনার যে আংকেল থাকে তিনি আপনাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, আপনার নিজের পায়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত তার বাড়িতেই থাকতে পারেন। তিনি আপনাকে এয়ারপোর্টে নিতে এসেছিলেন, একটা বড়সর হটডগ খাইয়েছিলেন যা সস দিয়ে খেতে গিয়ে আপনার বমিভাব হয়েছিল। তিনি হেসে বলেছিলেন, অ্যামেরিকার সাথে পরিচিত হও। তিনি মেইনের কোনো শ্বেতাঙ্গ পাড়ায় থাকেনÑ লেকের পাশে ত্রিশ বছরের পুরনো বাড়ি। তিনি জানালেন, তিনি যে কোম্পানিতে চাকরি করেন সেখান থেকে তাকে আরও কয়েক হাজার শেয়ার দিতে চেয়েছিল কারণ তারা নতুনত্ব চায়। কোম্পানির ব্রশিউরে তার ছবি ছাপিয়েছিল, যদিও তার কাজের সাথে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না। হাসতে হাসতেই তিনি আরও জানিয়েছেন তার চাকরিটা ভালো এবং শ্বেতাঙ্গ পাড়ার সবচে’ সম্মানজনক, যদিও প্রথমদিকে তার স্ত্রীকে একঘন্টা খুঁজে চুল কালো করা হয় এমন একটা সেলুন বের করতে হয়েছিল। আসলে এসব বলার উদ্দেশ্য ছিল কৌশলে আপনাকে অ্যামেরিকার হাবভাব বোঝানো, লেনদেনের ব্যাপারটা জানানোÑ অ্যামেরিকায় আপনি অনেক দিতে পারলেই শুধু অনেক পেতে পারেন।

তিনি আপনাকে দেখিয়ে দিলেন কীভাবে মেইন স্ট্রিটের গ্যাস স্টেশনে কাজের জন্য অ্যাপ্লাই করতে হবে এবং সেখানকার কমিউনিটি কলেজেও ঢুকিয়ে দিলেন। কলেজের মেয়েরা আপনার চুল দেখে খুব কৌতূহলী হয়ে উঠল, ফিতা খুলে ফেললে চুল কী ফুলে উপরে উঠে যায় নাকি নীচে নেমে যায়? সব চুল খাড়া থাকে? কীভাবে? কেমন করে? আপনি কি চিরুনি ব্যবহার করেন?

তাদের এসব প্রশ্নের উত্তরে আপনি কাষ্ঠ হাসি দেন। আপনার আংকেল এসব স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেয়ার পরামর্শ দেন। এসব নাকি অ্যামেরিকানদের অজ্ঞতা আর ঔদ্ধত্যের প্রকাশ। এরপর তিনি আপনাকে তার অভিজ্ঞতাটির কথা বললেন। তিনি নতুন বাড়িতে ওঠার কয়েক মাসের মধ্যেই নাকি সেখানকার সব কাঠবিড়ালিরা উধাও হয়ে যাচ্ছিল। প্রতিবেশীদের তখন ধারণা হলো আফ্রিকানরা বুঝি সবধরণের বন্যপ্রাণী খায় কারণ তারা ঐরকমই শুনেছে।

আপনি আংকেলের কথায় মজা পান এবং তার বাড়িকে নিজের বাড়ির মতোই মনে করতে শুরু করেন। তার স্ত্রী আপনার সাথে বোন পাতায় আর তার স্কুলবয়সী বাচ্চরা আপনাকে আন্টি ডাকতে শুরু করে। তারা ইগবোতে কথা বলে, লাঞ্চেতে গ্যারি খায়Ñ এ বাড়ির আবহাওয়া প্রায় দেশের মতোই। ট্রাংক, গাড়ির চাকা আর বইয়ে ঠাসা বেসমেন্টের একটা খুপরি ঘরে আপনাকে ঘুমাতে দেয়া হতো। কষ্ট হলেও চলে যাচ্ছিল কিন্তু আপনার আংকেল সেখানে এসে হঠাৎ এক রাতে গাছ থেকে আম পাড়ার মতো আপনার বুক হাতড়ানো শুরু করেন। তিনি আসলে আপনার রক্ত সম্পর্কের কেউ নয়, আপনার খালুর দূর সম্পর্কের কোনো কাজিন।

সেই রাতেই আপনি তল্পিতল্পা বাঁধতে শুরু করলেন। তিনি আপনার বিছানার পাশে বসলেন; যাই বলেন না কেন এটা তারই বাড়ি, এবং ক্রুর হেসে বললেন, আপনার যাওয়ার কোনো জায়গাই নেই। যদি আপনি ওর লোভী হাত দুটিকে সুযোগ দেন তবে তিনি আপনার জন্য অনেক কিছুই করবেন। স্মার্ট মেয়েরা সবসময় তাই করে। আপনি ভেবে পাননি এইসব স্মার্ট মেয়েরা কোন মুখে আকর্ষণীয় চাকরি নিয়ে লাওসে ফিরে যায় কিংবা নিউইয়র্কেই থাকে?

বাকি রাতটা আপনি বাথরুমে ছিটকিনি আটকে কাটিয়ে সকালে বের হয়ে এলেন। ঝড়ো রাস্তায় লেকের ছোট মাছের খেলা দেখতে দেখতে হেঁটে চললেন। আপনার আংকেল হর্ন না দিয়ে গাড়িতে আপনার পিছু নিলেন; অবশ্য তিনি সবসময়ই আপনাকে মেইন স্ট্রিটে লিফট দিতেন। আপনি ভাবতে লাগলেন, লোকটি তার স্ত্রীকে আপনার চলে যাওয়া নিয়ে কী জবাব দেবে। তখন তার কথাটা আপনার মনে পড়লÑ অ্যামেরিকা হচ্ছে লেনদেনের জায়গা।

আপনি সেই শহরের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বোনানজা বাসে চড়ে অন্য শহরে এলেন, যেটি ছিল ওই বাসের শেষ স্টপেজ। সেখানকার হাতের কাছের রেস্টুরেন্টটিতে ঢুকে মালিককে বললেন, আপনি অন্যান্য ওয়েট্রেসদের চেয়ে দুই ডলার কমে কাজ করতে চান। কালির মতো কালো চুলের আধিকারী জুআন একটু হেসে তার হলদেটে দাঁত বের করল, বলল, সে কখনো নাইজেরিয়ান কর্মচারি রাখেনি, অবশ্য এদেশে সব অভিবাসীদেরই কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। আরো বলে, সে নাকি নাইজেরিয়ায় গিয়েছিল। আপনাকে বেতনে মাত্র এক ডলার কম দেবে এবং তা টেবিলের নিচ দিয়ে; কর্মচারিদের জন্য কর দেয়া তার পছন্দ না।

এখন আপনার পক্ষে পড়াশুনা চালানো সম্ভব হয় না কারণ বিবর্ণ কার্পেটে মোড়ানো একটি ছোট্ট ঘরের ভাড়া আপনাকে যোগাতে হয়। ছোট্ট শহরটিতে কোনো কমিউনিটি কলেজ নেই। তাছাড়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াও বেশ খরচ সাপেক্ষ। তাই শুরু করলেন পাবলিক লাইব্রেরি যাওয়া, সেখানে স্কুল ওয়েবসাইটে কোর্স সিলেবাস দেখে কিছু বই পড়তে শুরু করলেন। আর মাঝে মাঝে আপনার ডাবল বেডের দলা পাকান তোষকে বসে বাড়ির কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

আপনার বাবা-মা, জ্ঞাতিগুষ্ঠি আর বন্ধুরা আম ও আকারা ফেরি করে কখনো মুনাফা করতে পারেনি। তাদের দস্তার পাতে তৈরি অস্থায়ী বাড়ি-ঘরÑ যা বর্ষা মরসুমে ভেঙ্গে পড়ে। ডিভিতে অ্যামেরিকার ভিসা পাওয়ার পর অনেক লোকজন আপনাকে বিদায় জানাতে এসেছিল, তাদের আনন্দ উচ্ছ্বাস আর ঈর্ষাও প্রকাশ করেছিল। তাদের ছেলেমেয়েরা যে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ে সেখানকার শিক্ষকেরা পর্যন্ত ডিভি পাঠানোর বাদামি খাম পেলে পরীক্ষায় ছাত্রদের ‘এ’ দিয়ে দেয়।

পরীক্ষায় ‘এ’ পাওয়ার জন্য আপনাকে টাকা খরচ করতে হয়নি, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে বাদামি খামও দিতে হয়নি। তবে এখন আপনি দেশে মা-বাবার কাছে বাদামি খামেই মাসের অর্ধেক বেতন পাঠিয়ে দেন। প্রতিমাসে জুআন আপনাকে যে বিল দেয় তা বখশিসের চেয়ে কম বলা যায়। এখন আপনি বাড়িতে চিঠি লিখেন না, আর লিখারই বা কী আছে? প্রথম কয়েক সপ্তাহ লিখতে চাইতেন কারণ তখন অনেক গল্প ছিল। আপনি অ্যামেরিকার আজব মানুষ সম্বন্ধে লিখতে চেয়েছিলেনÑ তারা কতটা উৎসাহের সাথে তাদের মায়ের ক্যান্সারের কাহিনী আপনাকে বলেছিল, তাদের ভাইয়ের ইঁচরে পাকা বাচ্চার কথা বলেছিলÑ যা কিনা গোপন রাখার বিষয়, শুধু পরিবারের লোকরাই জানবে এবং শুভ কামনা করবে। আপনি চিঠিতে জানাতে চেয়েছিলেন রেস্টুরেন্টে অ্যামেরিকানরা প্লেটে কত খাবার ফেলে যায় এবং যাওয়ার সময় বিলটা মুচড়ে প্লেটের নিচে রেখে যায় যেন টাকাটা নষ্ট করা খাবারের খেসারত। লিখতে চেয়েছিলেন সেই বাচ্চাটার কথা যে কেঁদে কেঁদে তার ব্লন্ড চুল টানছিল আর ওর মা-বাবা কান্না থামানোর পরিবর্তে ধমকে চুপ করতে বলছিল, তারপর বা”চ্চাটাকে রেখেই তারা উঠে গিয়েছিল।

আপনি আরও লিখতে চেয়েছিলেন আ্যামেরিকায় সবার বড় বাড়ি আর গাড়ি নেই। তবে এখনো আপনি তাদের বন্দুক থাকা নিয়ে সন্দিহান, যদি থাকে তবে তা হয়তো তাদের ব্যাগের ভিতরে বা পকেটে থাকে।

শুধু আপনার মা-বাবার কাছেই না, আপনার বন্ধু-বান্ধব, কাজিন ও আত্মীয়-স্বজনদেরও এসব বিষয় নিয়ে লিখতে চাইতেন কিন্তু তাদের জন্য আপনার যথেষ্ট পরিমাণ হাতব্যাগ, জুতা ও ভিটামিন জাতীয় খাদ্যদ্রব্য কেনার সামর্থ নেই। অতএব কাউকেই আপনার চিঠি লেখা হয় না।

কেউ জানে না আপনি কোথায় থাকেন, কাউকে জানানওনি। মাঝে মাঝে নিজেকেই আপনার অদৃশ্য লাগে, তখন চেষ্টা করেন আপনার রুমের দেয়াল ভেদ করে হলরুমে যেতে কিন্তু দেয়ালে বাড়ি খেয়ে আপনার হাতে কালশিরা পড়ে যায়। একদিন জুআন আপনাকে জিজ্ঞাসা করে বসল, কোনো ছেলের সাথে আপনার সম্পর্ক আছে কিনা যে আত্মরক্ষার্থে আপনাকে মেরেছিল। উত্তরে আপনি রহস্যময় হাসি দিলেন। প্রায় রাতেই আপনার মনে হয়, কিছু একটা গলা পেঁচিয়ে রয়েছে যা ঘুম ভাঙার আগেই আপনার শ্বাসরোধ করতে চায়।

কিছু লোক মনে করত আপনি জ্যামাইকান কারণ তারা ভাবতো এ ধরণের উচ্চারণ-ভঙ্গির সব কালোরাই জ্যামাইকা থেকে এসেছে। আবার কিছু লোক মনে করত আপনি অফ্রিকান। তারা জিজ্ঞাসা করত কেনিয়া বা জিম্বাবুয়ে-র অমুক তমুককে আপনি চেনেন কিনাÑ তাদের ধারণা আফ্রিকায় সবাই সবাইকে চেনে।
একদিন রেস্টুরেন্টের আধো অন্ধকারে আপনার টেবিলের কাস্টমারটিকে যখন খাবারের মেন্যু বলছিলেন, তিনি হঠাৎ জানতে চাইলেন, আফ্রিকার কোন দেশ থেকে আপনি এসেছেন। নাইজেরিয়া, উত্তর দিয়ে আপনি পরবর্তী প্রশ্নটার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন, যেটা হবেÑ সেনেগাল বা বতসোয়ানা শান্তি মিশনে তার যেসব বন্ধু রয়েছে তাদের আপনি চেনেন কিনা? কিন্তু সে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি ইয়োরুবা নাকি ইগবো সম্প্রদায়ের? যেহেতু আপনার চেহারা ফুলানি-দের মতো না।

আপনি অবাক, ভাবলেন, সে নিশ্চয়ই নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক হবে যদিও বয়সে তরুণ। ইগবো, আপনি উত্তর দিলেন। জুআন আপনার নাম জিজ্ঞেস করলো, বললো একুনা খুবই সুন্দর নাম। ভাগ্য ভালো সে আপনার নামের অর্থ জানতে চায়নি কারণ অনেকে বলতো এর অর্থ নাকি পিতার সম্পত্তি। আপনার কাছে এর অর্থ যথার্থই মনে হয়, যেমন আপনার বাবা স্বামীর কাছে আপনাকে বিক্রি করবে।

লোকটি ঘানা, কেনিয়া ও তানজানিয়া গিয়েছে এবং আফ্রিকার অন্যান্য দেশ সম্পর্কেও পড়েছে। পড়েছে তাদের ইতিহাস ও সমস্যা নিয়ে। নিজেকে লঘুজ্ঞান করে আপনি তার আজ্ঞাবহতা প্রকাশ করতে চাইলেন, যদিও শ্বেতাঙ্গরা, যারা আফ্রিকা খুব পছন্দ করে আর যারা অল্প পছন্দ করেÑ উভয়ই একই রকম সহানুভূতিশীল।

কিন্তু লোকটি বেশি জানার ভান করেনি, অ্যাংগোলা সম্পর্কে বলতে গিয়ে কমিউনিটি কলেজের অধ্যাপকটির মতো খুব জানার ভান করে মাথাও নাড়ায়নি, কোনো সহানুভূতিও দেখায়নি। পরের দিনও সে আপনার টেবিলে এসে বসলো, আপনি চিকেন স্যুপ দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, রান্না ঠিক আছে তো? তার বদলে সে আপনার কাছে লাওস সম্বন্ধে জানতে চাইলো। দ্বিতীয় দিন এসেও অনেকক্ষণ আলাপ করলো, রাজনীতি নিয়ে আপনার মত শুনতে চাইলো, আপনার কি মনে হয় না মবুটু আর ইদি আমিন দুজনের চরিত্রই এক? আপনি বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, রেস্টুরেন্টে এসব আলাপ নিষিদ্ধ। কফির কাপ টেবিলে রাখার সময় সে আপনার হাত স্পর্শ করলো। আপনি তৃতীয় দিন জুআনকে জানিয়ে দিলেন, ঐ টেবিলে আপনি আর কাজ করবেন না।

সেদিনই সে বাইরে খুটিতে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। আপনার কাজের শিফট শেষ হলে অনুরোধ করলো তার সাথে ‘দ্য লায়ন কিং’ ছবিটি দেখতে যেতে কারণ হেকুনা মেতাতা নামটির সাথে আপনার নামের মিল আছে আর ইমোশনাল মুভির মধ্যে একমাত্র ‘দ্য লায়ন কিং’-ই তার ভালো লেগেছে। উজ্জ্বল আলোতে আপনি তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন তার চোখের রং কচি জলপাই তেলের মতোÑ সবুজাভ সোনালি। অ্যামেরিকায় একমাত্র কচি জলপাই তেলই আপনি পছন্দ করতেন, সত্যিকারভাবে উপভোগ করতেন।

স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সে আপনার সিনিয়র ছিল, তবে বয়সে আনেক বড়। আপনি জানতে চাইলেন কেন তখনও তার গ্রাজুয়েশন শেষ হয়নি। Ñএটা অ্যামেরিকা, এখানকার শিক্ষাব্যবস্থা তোমাদের দেশের মতো নাÑ যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায়ই বন্ধ থাকে, আর লাগাতার ধর্মঘটের ফলে শিক্ষকদের লেকচার দেয়া সম্ভব হয় না যার ফলে শিক্ষার্থীদের পাশ করে বেরুতে তিন বছর বেশি লাগে। সে বলছিল হাইস্কুল পাশ করার পর সে বেশ কয়েক বছর সময় নিয়েছে নিজেকে জানতে এবং দেশভ্রমণ করেছে, যার বেশিরভাগই ছিল আফ্রিকা ও এশিয়ায়। আপনি প্রশ্ন করলেন, কখন তার নিজেকে জানা শেষ হলো। শুনে সে হেসে উঠলো কিন্তু আপনি হাসলেন না। আপনি জানতেন না স্কুলে যাওয়া না-যাওয়ার ব্যাপারটা অ্যামেরিকায় এতটাই সিম্পল যে ছেলেমেয়েরা এটা নিজেরাই ঠিক করে, নিজেরাই জীবনের নির্দেশন দেয়।

জীবন যা দিতে চায় তাই আপনি হাত পেতে নেন, জীবন যেদিকে নির্দেশ করে সেদিকেই আপনি যেতে অভ্যস্ত। পরের তিনদিনও লোকটির সাথে ঘুরতে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। কারণ আপনার কাছে এটা ঠিক মনে হয়নি আর সে যে দৃষ্টিতে আপনার দিকে তাকায় তাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না, যদিও তার সব কথার উত্তরেই আপনি সহজ হাসি দেন। কিন্তু চতুর্থ রাতে আপনার কাজ শেষ হলে তাকে আর অপেক্ষারত দেখা গেল নাÑ তখন আপনার খারাপ লাগতে লাগলো। এই প্রথম আপনি অনেক্ষণ প্রার্থনা করলেন এবং যখন সে সত্যি সত্যি আপনার পিছনে এসে অভিবাদন জানালো আপনি বললেন, হ্যাঁ, এখন আপনি সে অনুরোধ করার আগেই তার সাথে যেতে রাজী আছেন। কিন্তু আপনার ভয় হলো সে আর অফার করবে কিনা।

পরেরদিন সে আপনাকে চেন্জস রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। সেখানে আপনার কেকের সাথে দুটি লাকি কুপন পাওয়া গেল, অবশ্য দুটিই ব্ল্যাংক ছিল।
   
অন্য টেবিলে কাজ করতে চাওয়ার পিছনের কারণটি বলতে পেরে আপনি নতুন বয়ফ্রেন্ডের সাথে সহজ হয়ে উঠলেন। বর্ণবাদ, হ্যাঁ, বর্ণবাদÑ রেস্টুরেন্টের টিভি ক্যামেরায় দেখা যায় সবাই টেবিল ভাগ করে বসেÑ অইউরোপীয়, শ্বেতাঙ্গ, কালোÑ সবাই। সব বর্ণের মানুষের মধ্যে আপনি কিছুতেই শ্বেতাঙ্গদের পক্ষে নন। আপনার বয়ফ্রেন্ড কথা শুনে হেসে ওঠে, বলে, সে বর্ণবাদে বিশ্বাস করে না, তার মা তাকে এরকমই শিক্ষা দিয়েছে।

লাওসে আপনার বাবা স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি ট্যাক্সি চালানÑ এ কথা জানানোর পর আপনি আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছিলেন। একদিন বৃষ্টির দিনে আপনার বাবার ট্যাক্সিতে চড়ে আপনি ভিজে গিয়েছিলেন কারণ ট্যাক্সির জং ধরা ছাদের ফুটা দিয়ে পানি পড়ছিল। লাওসের রাস্তায় যানবাহন সংখ্যাতিরিক্ত, সবসময় জ্যাম লেগে থাকে আর বৃষ্টি হলে তো বিদিকিচ্ছিরি অবস্থা হয়। রাস্তাগুলোর ড্রেনেজ ব্যাবস্থা খুবই খারাপ; বৃষ্টির দিনে রাস্তার বড় খানাখন্দগুলোতে লোকজনের গাড়ি আটকে গেলে আপনার কাজিনরা গাড়ি ধাক্কা মেরে উঠিয়ে দিয়ে টু পাইস কামিয়ে নেয়। বৃষ্টি এবং পানিতে ডোবা রাস্তা বুঝে সেদিন আপনার বাবা সময় মাতো ব্রেক কষতে পারছিলেন না। তাই মাথায় বাড়ি খেয়ে ব্যথা অনুভূত হওয়ার আগেই আপনি শব্দ পাচ্ছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে সামনের যে গাড়িটিকে আপনার বাবা ধাক্কা মারে সেটা গাঢ় সবুজ রঙের একটি বড়সড় বিদেশি গাড়ি আর ওটার হলুদ হেডলাইট দুটো বেড়ালের চোখের মতো জ্বলছিল। ভয়ে আপনার বাবা কাঁদতে শুরু করলেন, গাড়ি থেকে বের হয়ে ক্ষমা চাইতে চাইতে রাস্তার উপর প্রায় শুয়ে পড়লেন। সরি স্যার, সরি স্যার, আমারে আর আমার চৌদ্দগুষ্ঠি বেচলেও আপনার গাড়ির একটা টায়ারের দাম উঠবো নাÑ আপনার বাবা অনবরত বলতে লাগলেন।

কিন্তু গাড়ির পিছনে বসা বিশাল লোকটি বের হলেন না, তার ড্রাইভার বের হয়ে ক্ষয়-ক্ষতি পরীক্ষা করলো। আপনার বাবার হাত-পা ছড়ানো শরীরটার দিকে চোখের কোণ দিয়ে তাকালো যেন তার কণ্ঠের মিনতি কোনো গান যা সে সবচে অপছন্দ করে। শেষমেশ আপনার বাবাকে মাফ করে দিলো এবং হাত নেড়ে চলে যেতে বললো। পেছনের গাড়িগুলোর চালকরা ততক্ষণে অবিরাম হর্ন দিতে দিতে অভিশাপ দিচ্ছিল। আপনার বাবা গাড়িতে এসে বসলে আপনার তার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করেনি। কারণ তখন তাকে মনে হচ্ছিল বাজারের চারপাশে জলাভূমিতে হেলেদুলে চলা এক শুয়োরের মতো, একটা কীটপতঙ্গের মতো।

আপনি এ কথা বলতেই আপনার বাবার মুখ হা হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারছি, তিনি আপনার হাত ধরলেন। আপনি বিরক্ত হয়ে হাত টানতে চাইলেন কারণ আপনার বাবার ধারণা দুনিয়ার সব মানুষই তার মতো সরল। আপনি উত্তর দিলেন, এখানে বোঝাবুঝির কিছু নেই, এর কোনো মানে হয়না।

আপনার বয়ফ্রেন্ড মাংস খায় না, কারণ যেভাবে এদের হত্যা করা হয় পদ্ধতিটা ঠিক না। সে বলে, এগুলোকে টক্সিন দেয়া হয় আর টক্সিন মানুষের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে। কিন্তু বাসায় যেদিন মাংস রান্না করতেন আপনি আধেক আঙ্গুলের সমান টুকরাগুলো নির্দ্বিধায় খেতেন। তবে এ কথাটা বললেন না। আপনি এও বললেন না যে, কারি ও টাইম পাতার খুব দাম হওয়ার কারণে আপনার মা ডুমা ডুমা করে কাটা মাংস সবকিছুর সাথেই রান্না করতো যাতে এম.এস.জি (মনোসোডিয়াম গ্লুন্টামেইট) থাকে। আপনার বয়ফ্রেন্ড জানালো, এম.এস.জি ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। এ জন্যই চেনজস রেস্টুরেন্টটি তার পছন্দÑ ওখানে রান্নায় এম.এস.জি ব্যবহার করে না।
একবার চেনজসের এক ওয়েটারকে আপনার বয়ফ্রেন্ড বললো, সে একবছর সাংহাইতে ছিল এবং কিছু মান্দারিনও বলতে পারে। ওয়েটার খুশি হলো আর সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিলো, তাদের রেস্টুরেন্টের কোন সুপটা সবচে ভালো। এরপর জিজ্ঞেস করলো, সাংহাইতে আপনার গালফ্রেন্ড আছে, তাইনা? জবাবে আপনার বয়ফ্রেন্ড শুধু মুচকি হাসলো।

নিমিষেই আপনার ক্ষুধা উবে গেল আর বুকের নিচের অংশটাতে কেমন করতে লাগলো। সেই রাত্রে সে আপনার ঘর পর্যন্ত এলেও আপনি বাধা দিলেন না, ঠোঁট কামড়ে এমন ভাব করলেন যেন আপনি ঘরেই আসেননি কারণ আপনি জানতেন এতে সে কষ্ট পাবে। অবশেষে আপনার বয়ফ্রেন্ডের কাছে আপসেট হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করলেন। ঐ চাইনিজ ওয়েটার মনে করেছে আপনি কখনো তার গার্লফ্রেন্ড হতে পারেন না, আর এজন্যই বুঝি সে জবাবে মুচকি হেসেছিল?

ক্ষমা চাওয়ার আগে বয়ফ্রেন্ড আপনার দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো, আর আপনি বুঝে গেলেন যে সে আদপেই ব্যাপারটা বোঝেনি।

বয়ফ্রেন্ড আপনাকে গিফট কিনে দিলো। আপনি দামের কারণে আপত্তি জানালে বললো, তার একটা ট্রাস্ট ফান্ড রয়েছে, কোনো সমস্যা হবে না। তার গিফটে আপনি অবাক হলেনÑ একটি মুঠি সাইজ বল যা দিয়ে একটি ছোট ঘরে তুষারপাতের পরিমান মাপা যায়, একটি উজ্জ্বল পাথর আর একটি মেক্সিকান দামি স্কার্ফ। তবে স্কার্ফটি বোধ হয় আপনার পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব হবে না কারণ ওটার রঙ পছন্দ হয়নি। এক পর্যায়ে আপনি তাকে বললেন, আসলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে এমন গিফট দেয়া হয় যেসব কাজে লাগে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দামি পাথরটাকে আংটি বা লকেট বানিয়ে পরলেই শুধু এর উপযোগিতা রয়েছে। এটা শুনে সে লম্বা হাসি হাসলো কিন্তু আপনি হাসতে পারলেন না। আপনি বুঝতে পারলেন আপনার বয়ফ্রেন্ড জীবনভর এমন সব গিফটই কিনেছে যেগুলো শুধু গিফটই, কোনো কাজে আসার জন্য নয়। তারপর থেকে সে জুতা, কাপড় ও বই গিফট দেয়া শুরু করলে আপনি নিষেধ করলেন, বললেন, আপনার কোনো গিফটই দরকার নাই।

এখন আর আপনি আগের মতো নেই, সত্যিই নেই। নিজের সাথে অনেক বাকবিত-ার পরে আপনি মনস্থির করেছেনÑ বয়ফ্রেন্ডকে ভালবেসে ফেলেছেন। এখন আপনাদের হাত পরস্পরের চুলে খেলা করেÑ তার ভুট্টার খোসার মতো হলদে চুেল আর আপনার নরম বালিসের মতো তুলতুলে কালো চুলে। তার বাহুবন্ধনে আপনি নিরাপদ বোধ করেন, যেমন  নিরাপদ আপনি আপনার ফেলে আসা বাড়িতে বোধ করতেন Ñ দস্তার পাতে তৈরি বস্তির অস্থায়ী ঘরে।

রৌদ্রস্নান বেশি হয়ে গেলে ওর চামড়া পাকা তরমুজের মতো লাগে তখন ধীরে ধীরে লোশন লাগানোর আগে আপনি তার পিঠে চুমু খান। এটা মিলনের চেয়ে বেশি উপভোগ্য। আপনি শুধু গুটিয়ে যাচ্ছিলেন যদিও আপনাদের দুজনের ক্ষেত্রে এত কাছাকাছি আসার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। আপনার গায়ের চামড়া খুবই কালো তাই রৌদ্রস্নানে চামড়া পুড়তে শুরু করলেও বোঝা যায় না। বয়ফ্রেন্ড ইয়োলো পেজেস থেকে একটি আফ্রিকান স্টোর খুঁজে আপনাকে সেখানে নিয়ে গেল। ওটার মালিকটার দেশ ঘানা। সে আপনার বয়ফ্রেন্ডকে দেখে জিজ্ঞেস করল, কেনিয়া বা দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের মতো সেও আফ্রিকান কিনা। বয়ফ্রেন্ড হেসে বললো, হ্যাঁ এবং অ্যামেরিকাতে অনেক বছর থাকার ফলে সে তার শৈশবের খাবারগুলো মিস করছে। অতএব আপনি তার জন্য রান্ন্া করলেন। সে ভাত পছন্দ করলো কিন্তু গ্যারি ও স্যুপ গেলার সাথে সাথে তা সিঙ্কে উগরে দিলো। আপনি মন খারাপ না করে এরপর মাংস দিয়ে স্যুপ রান্না করলেন।

রাত্রে আপনার ঘুমের ভিতর গলা চেপে শ্বাসরোধ করার যে দুঃস্বপ্নটা আপনাকে তাড়িয়ে বেড়াতো, তখন থেকেই ক্রমে তা আপনাকে ছেড়ে যেতে শুরু করলো।

লোকজনের প্রতিক্রিয়া দেখে আপনি বুঝতে পারলেন তারা আপনাকে অ্যাবনরমাল ভাবছেÑ যেন আপনাদের মধ্যে সুন্দর অসুন্দরের খেলা চলছে। বুড়ো শ্বেতাঙ্গ মহিলারা আপনার বয়ফ্রেন্ডকে দেখে কানাঘুষা করে, কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষরা আপনাকে দেখে মাথা ঝাকায় এবং কৃষ্ণাঙ্গ মহিলারা করুণ চোখে অসন্তুষ্টভাবে তাকায় যে মনে হবে আপনার বোধ হয় আত্মসম্মানবোধের অভাব আছে। অথবা কিছু কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা মৃদু হেসে গোপনে সমর্থন জানায় আবার কিছু কৃষ্ণাঙ্গ লোক আপনাকে মন থেকে ক্ষমা করতে চায়, কিন্তু না পেরে আপনার বয়ফ্রেন্ডকে হাই জানায়। কোনো কোনো শ্বেতাঙ্গ মহিলা আবার সহাস্যে জোর গলায় বলে, কী সুন্দর জুটি! যেন তারা নিজেদেরকেই বোঝাতে চায় তারা তাকে সহ্য করতে পারছে।
আপনি বয়ফ্রেন্ডকে বলতেন না ঠিকই কিন্তু মনে মনে চাইতেন যদি আপনার রঙটা আরেকটু ফর্সা হতো তবে মানুষজন হয়তো এভাবে তাকিয়ে থাকতো না। আপনার বোনের কথা মনে পড়ল, যার গায়ের রঙ মধুরঙা। ইস আপনারও যদি সেরকম হতো! বয়ফ্রেন্ডের মা-বাবার সাথে যে সন্ধ্যায় আপনার প্রথম পরিচয় হলো সেদিনও আপনি এরকম ইচ্ছা করেছিলেন। কিন্তু বয়ফ্রেন্ডকে ইচ্ছার কথাটা জানালেন না কারণ সে বেজার হবে, তখন আপনার হাত ধরে বলে বসবে, আপনার বার্নিস করা গায়ের রঙই তাকে প্রথম আকৃষ্ট করেছিল। আপনি চাইলেন না সে আপনার হাত ধরে আবার কথাটা বোঝাক কারণ এতে নতুন করে বোঝাবুঝির কিছু নেই।

আপনার গায়ের রঙ আরেকটু ফর্সা হলেই পুয়ার্তো রিকানদের মতো লাগতো। তাহলে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে আপনার বয়ফ্রেন্ডের মা-বাবার সাথে সমুচা খাওয়ার সময় ডিম লাইটের আলোতে আপনাকে প্রায় তাদের মতোই দেখাতো।

বয়ফ্রেন্ডের মা বলেছিলেন, আপনার চুলে বাধা কড়ি-ক্লিপ তার পছন্দ হয়েছে এবং জানতে চেয়েছিলেন ওগুলো আসল কিনা, আর লেখিকাদের মধ্যে আপনি কাদের বই পড়েন। ওর বাবা জানতে চাইলেন, ইন্ডিয়ান খাবারের সাথে নাইজেরিয়ান খাবারের মিল কতটুকু। শেষে খাবারের বিলটা আপনি দিতে চাইলে তিনি আপনাকে ভর্ৎসনা করেন। আপনি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ হলেন কারণ তারা আপনাকে কোনো বিদেশি ট্রফি বা হাতির দাঁত দেখার মতো পর্যবেক্ষণ করেননি।

ওর মা আপনাকে আরো বললেন, পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়ার দিন ছাড়া হাইস্কুলের পরে তার ছেলে কখনো কোনো মেয়েকে তাদের সাথে পরিচয় করাতে নিয়ে আসেনি। আপনার বয়ফ্রেন্ড তখনই কাষ্ঠ হেসে আপনার হাত ধরলো। টেবিল ক্লথে আপনাদের হাত আটকে রইলো, সে হাত মোচড়াতে লাগলো, আপনিও তাই করলেন এবং অবাক হলেন, ও এরকম শক্ত করে চাপ দিচ্ছে কেন, আর কেনইবা মা-বাবার সাথে কথা বলার সময় ওর কাঁচা-জলপাই রঙা চোখ অনুজ্জ্বল হয়ে যাচ্ছে। সে আপনাকে পরে মা-বাবার সাথে তার সমস্যার কথাটা খুলে বলেছিলÑ কীভাবে তারা ভালবাসাকেও কেটে জন্মদিনের কেকের মতো ভাগ করেছিল। যদি সে ল-স্কুলে পড়তে যেত তবে তারা তাকে কেকের একটি বড় টুকরা দিতো। কিন্তু বয়ফ্রেন্ডের কথায় সহানুভূতির বদলে কেন জানি আপনার তার প্রতি রাগ হলো।

মা-বাবার সাথে সে মাত্র এক বা দুই সপ্তাহের জন্য ক্যানাডার কুইবেক গ্রামে তাদের গ্রীষ্মকালীন কটেজে যেতে রাজি হয়নিÑ এ কথা শুনে আপনি অরো বেশি রেগে উঠলেন। মা-বাবা নাকি এমনকি আপনাকে সাথে নেয়ার অনুমতিও দিয়েছিল। বয়ফ্রেন্ড আপনাকে সেই কটেজটার ছবি দেখালে আপনি ভেবে আশ্চর্য হলেন যে কেন এটাকে কটেজ বলছে। কারণ ঐ কটেজের বিল্ডিংটা আপনার দেশের বাসার আশেপাশের বাড়ি-ঘর, ব্যাংক ও চার্চকে মিলালেও তার চেয়ে বড় হবে! আপনার হাতের গ্লাসটা ঠাস করে তার অ্যাপার্টমেন্টের মেঝেতে পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। কোনো সমস্যা? বয়ফ্রেন্ড জিজ্ঞেস করলো। না, আপনি তড়িৎ উত্তর দিলেন। যদিও আপনার মনে হয়েছিল সমস্যাটা বিশাল আর মুহূর্তে আপনার চেনা পৃথিবী অচেনা হয়ে গিয়েছিল।

পরে শাওয়ারে এসে আপনি কাঁদতে শুরু করলেন, আপনার চোখের জল শাওয়ারের জলের সাথে মিশে যাচ্ছিল কিন্তু আপনি জানেন না কেন কাঁদছিলেন।

রাত্রে ঘুমের মাঝে ঘাড় চেপে ধরার দুঃস্বপ্নটা একসময় আপনাকে পুরোপুরি ছেড়ে গেল। বহুদিন পর আপনি সামান্য ইনকাম থেকে অল্প ডলার ব্যয় করে বাড়িতে মা-বাবা, ভাই-বোনের কাছে ছোট্ট একটি চিঠি লিখলেন, আপনার নিজের ঠিকানাটাও দিলেন। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই কুরিয়ারে চিঠির উত্তর এলো। আপনার মা নিজ হাতে লিখেছেনÑ প্যাচানো সুন্দর হস্তাক্ষরে ভুল বানানে লেখা।

আপনার মা লিখেছেন, পাঁচমাস গত হলো আপনার বাবা ট্যাক্সির স্টিয়ারিং-এ মাথায় আঘাত পেয়ে মারা গেছেন। আপনার পাঠানো টাকা দিয়ে ভালমতোই তার সৎকারের ব্যবস্থা হয়েছে। কাঠের না, ভালো কফিনে কবর দেয়া হয়েছে। অতিথিদেরও ছাগল জবাই করে খাওয়ানো হয়েছে।

আপনি বিছানায় উপুর হয়ে হাঁটুতে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলেন। আপনার বয়ফ্রেন্ড আপনাকে সান্ত¡না দিলো, মাথায় হাত বুলিয়ে জানালো, সে আপনার সাথে নাইজেরিয়া যেতে প্রস্তুুত। আপনি বললেন, না, আমার একাই যেতে হবে। সে জানতে চাইলো, আপনি আর ফিরে আসবেন কিনা। আপনি তাকে আপনার গ্রিনকার্ডটির কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন যেটি একবছরের মধ্যে ফিরে না এলে বাতিল হয়ে যাবে। সে বললো, না, সেটা না, আমি শুধু জানতে চাই তুমি ফিরে আসবে কিনা।

আপনি উত্তর না দিয়ে আলিঙ্গনমুক্ত হলেন। সে আপনাকে তার গাড়িতে করে এয়ারপোর্টে নিয়ে আসে। বিদায় জানাতে গিয়ে আপনি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন। খুব শক্ত, আপনার পাঁজরে ব্যাথা না পাওয়া পর্যন্ত। তারপর বললেন, ধন্যবাদ।

অনুবাদ : রাহাদ আবির



লেখক পরিচিতি
চিমানদা নগোজি আদিচি -র জন্ম ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭, নাইজেরিয়া। মেডিসিন ও ফার্মেসিতে নাইজেরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাসের পর তিনি অ্যামেরিকায় যান। সেখানে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর ওপর এম.এ করেন। তার প্রথম উপন্যাস পারপল হিবিসকাস (২০০৩) বেশ সাড়া ফেলেছে। বইটি ‘অরেঞ্জ ফিকশন প্রাইজ’-এর জন্য মনোনীত হয় এবং বেস্ট ফার্স্ট বুক হিসেবে ‘কমনওয়েলথ রাইটার্স প্রাইজ’ লাভ করে। তার দ্বিতীয় উপন্যাস হাফ অফ এ ইয়োলো সান ; একই নামে তার একটি গল্পও রয়েছে। চিমানদা বর্তমানে বছরের কিছু সময় নাইজেরিয়া আর কিছু সময় অ্যামেরিকায় কাটান। আপনি যখন অ্যামেরিকায় তার ইউ ইন অ্যামেরিকা গল্পের অনুবাদ। গল্পটি ‘কেন প্রাইজ ফর আফ্রিকান রাইটিং’-এর শর্টলিস্টে ছিল।

No comments:

Post a Comment