সাক্ষাৎকার : ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর
প্রশ্ন : দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
উত্তর : প্রত্যেক সৎ অভিপ্রায়বিশিষ্ট নাগরিকমাত্রই চায় দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অসুস্থতার অবসান হোক। আমাদের দেশের বাইরের শুভাকাক্সক্ষীরাও তা চায়। সবাই চায় বাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ লাভ করুক। কিন্তু জটিল অস্থিতিশীলতা আমাদের অর্জনের পথে এমন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে, এর থেকে উত্তরণের টেকসই সমাধান দুরূহ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ও শাসনপ্রক্রিয়ার অভিনব কপট রীতিনীতি প্রতিপক্ষকে অস্বীকার করে চলছে এবং গুরুতর সঙ্কটকে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বলে কানাগলিতে নিয়ে নিঃশঙ্ক দেখাতে সচেষ্ট। শুধু তাই নয়, গভীরে প্রোথিত সঙ্কটকে পুরুষতান্ত্রিকতার ছদ্মবেশে দুই ‘যুদ্ধংদেহী বেগম’ এর মধ্যকার কাজিয়া হিসেবে বিবেচনা করে খারিজ করে দেয়ারও এক ধরনের প্রয়াস লক্ষণীয়। দেখা যায়, কেউ কেউ বেপরোয়া এ পরিস্থিতির মধ্যে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রের’ নজির খুঁজছেন; আবার কেউ নিজ দলীয় অবস্থানের কূপে আশ্রয় নিয়ে শুধু নির্বাচনের মধ্যে এ সঙ্কটকে সীমাবদ্ধ করে রাখেন। মূলত স্বার্থীয় অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে সমর্থকরা মনগড়া অভিমত দিয়ে চলছেন। অন্যদিকে মূল সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। এভাবে আসলে আমাদের জাতীয় বৈরিতা ও বিভক্তির প্রকাশ ঘটছে।
প্রশ্ন : রাজনৈতিক সংঘাত আমাদের দেশে নতুন নয়। তবে এত সময় নিয়ে স্থবিরতা কখনও নেমে আসেনি। এ সঙ্কটের উৎস কোথায় বলে মনে করেন?
উত্তর : রাজনৈতিক সংঘাত ও ক্রোধে এরই মধ্যে শতাধিক লোক মারা গেছেন। এরা মারা গেছেন পেট্রলবোমার আগুনে পুড়ে, মারা গেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এবং আন্তঃদলীয় সংঘর্ষে। এক হাজারের অধিক গাড়িতে অগ্নিসংযোগ হয়েছে, বিভিন্ন সময় রেলপথ থেকে প্লেট সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এখনও ঢাকা মেডিকেল কলেজ বার্ন ইউনিটে ঝলসে যাওয়া প্রচুর লোক মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। আন্দোলনকারী বিরোধী দলের হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে; তাদের বেশিরভাগ নেতা হয় জেলে কিংবা আত্মগোপনে আছেন। অনেক নেতাকেই বহুসংখ্যক ফৌজদারি মামলার মাধ্যমে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা হয়েছে। অথচ সমস্যার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। বলা যায়, সঙ্কটের মূলের সূক্ষ্মতা উপলব্ধির ব্যর্থতার কারণেই সমস্যা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্কট এবং জনগণের ক্ষমতায়নের কমতির ফলেই সৃষ্টি হচ্ছে মানবীয় দুর্গতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ইত্যাদি। এ অবস্থা বলবৎ থাকলে চরমপন্থার উত্থানের পথ তৈরি হবে, যা দেশের অস্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘকালীন আর্থরাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষয়ক্ষতি বয়ে আনবে।
প্রশ্ন : দেশে অস্থিরতা তৈরি হলে ভুক্তভোগী হয় সাধারণ জনগণ। বারবারই এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেখানে কর্তৃত্বপরায়ণ, রাজনীতি যেখানে স্বেচ্ছাচার, সেখানে নাগরিক ক্ষমতার অবস্থানটি কোথায়?
উত্তর : রাজনৈতিক অস্থিরতা বন্ধে মিডিয়া যে অবস্থান গ্রহণ করেছে, তা আমি সঠিক মনে করি। তারা বলছেন, নিরপরাধ শিশু ও নারী, মা ও বাবাকে আগুনের ঝলসানো থেকে রক্ষা করুন। এমন একটি ভয়শূন্য পরিবেশ নিশ্চিত করা হোক যেখানে ছাত্রছাত্রী নিঃশঙ্কে তাদের স্বপ্ন এগিয়ে নেবে, কৃষক নির্বিঘেœ চাষাবাদ করবে, শ্রমিকরা কাজ করতে পারবে, যানবাহন সচল থাকবে, কারখানা চালু থাকবে, ব্যবসায় তেজিভাব থাকবে। রাষ্ট্রের কাছে এ ধরনের স্বাভাবিক কাম্যতা প্রত্যেক নাগরিকেরই প্রত্যাশিত। কিন্তু কার্যকর গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, যা চলমান স্থবিরতার মূল কারণ, উপরন্তু তা নাগরিকের অধিকারেও সঙ্কট তৈরি করেছে। এ অবস্থা জনগণের জন্য বড় ধরনের অস্বস্তি তৈরি করেছে, ফলে তাদের জীবন, স্বাধীনতা, স্বাস্থ্য, সর্বোপরি কল্যাণমূলক সবকিছুতেই ন্যূনতম প্রাপ্তিও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
২৫ বছর ধরে আমরা লক্ষ্য করছি, নির্বাচনের চতুর্থ বছরের পর সংঘাত যেন একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। জাতীয় সংসদ আক্ষরিক অর্থে এখন পর্যন্ত কার্যকারিতার প্রকাশ ঘটাতে পারেনি; প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি পদচিহ্ন। অধিকাংশ অধিবেশনে বিরোধী দলের নিয়মিত বয়কট যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। সংসদ সদস্যরা বেশিরভাগ সময়ই তাদের মূল দায়িত্বের বাইরের বিষয় নিয়ে নিমগ্ন থাকেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতির মূল সঙ্কটই প্রতিফলিত হয়, একইসঙ্গে নাগরিক ক্ষমতায়নের হ্রাসপ্রাপ্তি উন্মোচিত হয়। এক্ষেত্রে নাগরিকের ভোটাধিকার হরণ একটি দৃশ্যমান উপদ্রবের নজির। আমরা দেখছি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার উদগ্রী বাসনা, আবার সহিংসতার মাধ্যমে ক্ষমতার উৎপাটন করার তীব্র আকাক্সক্ষা, কোনোরূপ সার্বিক নির্বাচন ব্যতিরেকেই এসব চলছে। নিঃসন্দেহে এগুলো জনগণের জন্য ক্ষমতার চর্চা নয়! আবার ক্ষমতা প্রয়োগে নাগরিকের জন্য কোনো সুযোগও তিরোহিত থাকছে। নাগরিক অধিকার ও ক্ষমতার অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রের বড় ধরনের অধঃপতন ঘটে। ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টমাস হবসের মতে, ‘ক্রমাগত ভয় এবং নৃশংস মৃত্যুর বিপদ এবং মানুষের জীবন, সংহতি, দরিদ্র, জঘন্য, পাশবিক ও হীন করে তোলে।’
প্রশ্ন : নাগরিকের সঙ্গে অধিকারের সম্পর্কটি কিরূপ? নাগরিক ক্ষমতায়নের পরিস্থিতি নিয়ে কিছু বলুন?
উত্তর : ‘নাগরিক’ শব্দটির রয়েছে বেশ কিছু সহজাত অর্থ। তবে এর সহজ একটি মানে হলোÑ ব্যক্তি ন্যূনতম কিছু স্বাধীনতা ভোগ করবে। নাগরিক অধিকার একজন ব্যক্তিকে করে তোলে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী, রাষ্ট্র তার ওপর জ্ঞাপন করে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার। উদারপন্থীরা ‘নেতিবাচক স্বাধীনতা’র সমর্থক; তারা মনে করেনÑ হস্তক্ষেপমুক্ত অধিকার, প্রতিবন্ধকতার অবসান এবং অন্যের কোনো ক্ষতিসাধন নয়। সুতরাং নাগরিকত্ব ও অধিকার বলা যায় হাত ধরাধরি করে চলে এবং তা অবিচ্ছেদ্য ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্যই পরম।
এখন যদি আমরা বাংলাদেশের দিকে তাকাই, তাহলে কি বলা যাবে, এখানে কি নাগরিকরা যথেষ্ট ক্ষমতায়িত হতে পেরেছে? তারা কি স্বাচ্ছন্দ্যে ভোটের স্বাধীনতা উপভোগ ও চর্চা করতে পারছে? পারছে কি মুক্তভাবে চিন্তাভাবনা, বক্তৃতা, অভিব্যক্তি, সমিতি, সমাবেশ ও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে? আরও মৌলিকভাবে বলতে গেলে, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য আমরা কি অন্যের সঙ্গে ইতিবাচক সামাজিক ও সমবায়ী সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষমতা দেখাতে পারছি? আমরা মানবীয় প্রজাতি, অবশ্যম্ভাবীরূপে সামাজিক জীব হিসেবে কি পারছি ইতিবাচক ধারায় টেকসই সামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমে সক্ষমতা অর্জন নিশ্চিত করতে? এসব প্রশ্নের উত্তর সুখকর নয়।
প্রশ্ন : তাহলে কি বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি নাগরিক রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হয়নি?
উত্তর : এ প্রশ্ন আরও কিছু ধারাবাহিক প্রশ্নের অবতারণা দাবি করে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র কি নাগরিক রাষ্ট্র হওয়ার চেষ্টা করেছে? রাষ্ট্র কি অংশগ্রহণের ব্যাপ্তি, রাজনৈতিক সমতা, আধিপত্যের বিরুদ্ধে সুরক্ষা এবং নাগরিক ও রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন দৃঢ়করণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে? তাত্ত্বিক জটিলতায় না গিয়ে আমরা বলতে পারি, রাষ্ট্র হলো এর নাগরিকের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, এটা সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে গাঁটছড়া বাঁধা, এ বিমূর্ত সংগঠনটি সংবিধানের মাধ্যমে বাস্তবাকৃতি পেয়ে থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে জনগণের শত শত বছরের নিরন্তর সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়। তাদের প্রত্যাশা ছিল জনরাষ্ট্রের, ওই জনরাষ্ট্র নিশ্চিত করবে ‘সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামজিক ন্যায়বিচার’। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে এ অঙ্গীকার ঘোষিত হয়েছে। আমাদের মধ্যে কি কোনো সামাজিক চুক্তি হয়েছেÑ বাস্তবে আমাদের সংবিধানে সেসব অপরিহার্য নীতির যথার্থ প্রতিফলন হয়েছে কি? আমাদের এখানে কি রিপ্রেজেন্টেশনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি গড়ে উঠেছে, যেখানে নাগরিকের ইচ্ছা ও বৈচিত্র্যের প্রতিফলন ঘটেছে? আমরা কি জনরাষ্ট্রের শর্তগুলো আদৌ পূরণ করেছি? আমাদের কি এমন কোনো কার্যকরী প্রতিষ্ঠান, কাঠামো ও ব্যবস্থা রয়েছে, যেগুলো দেশে-বিদেশে আমাদের আগামী দিনের কৌশলগত স্বার্থ সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করবে? এখানে গভীর অনুসন্ধানের বিষয় রয়েছে অন্ততপক্ষে বর্তমানের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ও সাংগঠনিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতা উন্মোচন অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। অধিকন্তু রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রের অঙ্গগুলো, প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগ ইত্যাদির অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের মধ্যে প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁজতে হবে। এরপরই নাগরিকবান্ধব রাষ্ট্রের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। এর জন্য নিঃসন্দেহে ব্যাপকভিত্তিক পরিবর্তন আবশ্যক হয়ে উঠবে।
প্রশ্ন : দেশে সম্পদ নিয়ে দুর্বৃত্তায়ন ঘটছে। এর পেছনে রাজনৈতিক প্রশ্রয় কিংবা শাসন ব্যবস্থার সংস্রব রয়েছে কি?
উত্তর : সুস্পষ্ট কিছু কারণে বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পদের আদিম পুঁজিভবন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ প্রক্রিয়ায় সম্পদ আহরণে ক্ষমতা ও জবরদস্তির দেদার ব্যবহার হচ্ছে। ক্লায়েন্টালিস্ট রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এসব ক্লায়েন্টালিস্ট সম্পদনির্ভর নেটওয়ার্ক উল্লম্ব স্তরে (স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে) একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। অনুরূপ আনুভূমিকভাবে ব্যবসা, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার ব্যবস্থার কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কিত। যেমনÑ মিডিয়া প্রচুর প্রতিবেদন প্রকাশ করছে, রাজনৈতিক দলের নেতারা ক্যাডার ও মাস্তান পুষে জনগণের সম্পদ দখলচ্যুত করছে, নিরীহ মানুষের সম্পদ লুটতরাজ করছে। মিডিয়া বলছে, পুলিশ সাধারণত বেআইনি কাজের জন্য শাসক দলের নেতা বা ক্যাডারদের গ্রেফতার করে না, কারণ তারা সরকারের আসকারা পেয়ে থাকে। প্রশাসনও দূরে থাকে, কারণ তারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আনুকূল্য পায়। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতির নেতা শাসকগোষ্ঠীর সমর্থন নিয়ে নেতৃত্বে আসীন হয়ে থাকেন। সম্পদের দখলদারি রাখতে শুধু মধ্যবর্তী শ্রেণীগুলোর মধ্যেই রেষারেষি চলে না, এর মধ্য থেকে রাজনীতির বোঝাপড়াও স্থির হয়ে থাকে। মোটাদাগে মধ্যবর্তী শ্রেণীগুলোয় অন্তর্ভুক্ত হলো ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কৃষক, শহুরে পেটি-বুর্জোয়া এবং শিক্ষিত শ্রেণী। এ মধ্যবর্তী শ্রেণীগুলোর অন্তর্ভুক্ত নয় মজুর, গরিব কৃষক এবং শিক্ষিত বেকার। তবে মধ্যবর্তী শ্রেণীগুলো তাদের বাইরের অধিকাংশ মানুষ থেকে সাংগঠনিকভাবে বেশ মজবুত। এ প্রক্রিয়াটি প্রকৃত এলিট কিংবা বুর্জোয়া শ্রেণী গঠনে সঙ্কট তৈরি করছে এবং আইনভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠছে না।
প্রশ্ন : সর্বত্র যেখানে নাগরিক অধিকার সঙ্কুচিত, সেখানে নাগরিক ক্ষমতা সংরক্ষণের উপায়টি কীভাবে হবে?
উত্তর : বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক অধিকার এবং জনপর্যায়ের প্রধান অন্তরায় হলো রিপ্রেজেন্টেশন বা প্রতিনিধিত্বের অভাব ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ। বাংলাদেশে যেভাবে ভোটের অধিকার হরণ বহাল আছে, যদিও এটাকে ছায়াচ্ছন্ন যুক্তি এবং ক্ষমতার একাধিপত্যের মাধ্যমে বৈধতা দেয়ার উদ্যমের কমতি নেই। এ পরিস্থিতিতে সাধারণ নাগরিকরাই প্রকৃতপক্ষে নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠতার মধ্যে অবস্থান করছেন, তারা তিনটি ইস্যুতে রিপ্রেজেন্টেশনের বিন্যাস পরিবর্তনের জন্য আলোচনা করতে পারেনÑ প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়া, আইন প্রণেতাদের এখতিয়ার এবং নির্বাচন পরিচালনার সংগঠন। এ তিনটি ক্ষেত্রে যথেষ্ট সংস্কার হলে অবশ্যই ক্ষমতার কেন্দ্রীভুবন থেকে দূরে সরে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। এক্ষেত্রে বর্তমান ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ বা এলাকাভিত্তিক এক ব্যক্তি এক ভোট ব্যবস্থা নিয়ে পুনর্ভাবনায় যেতে হবে, এখানে দেখা যায় ন্যূনতম ভোট পেয়ে সর্বোচ্চ আসন জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আনুপাতিক ভোটের মিশ্র পদ্ধতির সমন্বয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা যেতে পারে। সে সঙ্গে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা করা যেতে পারে এবং উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচনে ঘূর্ণায়মান ব্যবস্থা থাকতে পারে। উচ্চকক্ষে নিশ্চিত করা যেতে পারে সমাজের বিভিন্ন পেশা ও শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধিত্ব। এ নির্বাচিত উচ্চকক্ষের দলনিরপেক্ষ সংসদ সদস্য সমন্বয়ে প্রত্যক্ষ ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচনকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে। ফলে ব্যাপক অংশগ্রহণের যেমন পরিধি বাড়বে, তেমনি একাধিপত্য সীমাবদ্ধ হবে। দৃশ্যত নিষ্ফল সংসদ। তবে সংসদ সদস্যরা আর্থিক ও অ-আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেই অত্যুৎসাহী। এ বিষয়টি সঠিক মাত্রায় পরিহার করা সম্ভব, যদি সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স সম্পন্ন করতে পারে এবং সরকারের নির্বাহী বিভাগের ওপর সংসদের ওভার সাইট ক্ষমতা থাকে। সংসদ সদস্যের বিশেষ অধিকার আইন যেমন দরকার; একইভাবে দায়বদ্ধতার জন্য তাদের আচরণবিধি প্রণয়ন প্রয়োজন। প্রয়োজন রাজনীতির অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার আইন। সংবিধানে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এমন বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে, যাতে করে নির্বাচন কমিশন সামগ্রিকভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় পুরোপুরি দায়বদ্ধ থাকবে। তাহলে শাসন প্রক্রিয়ায় জনগণ অংশগ্রহণের একটি ক্ষেত্র পাবে। তারা ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ পাবে।
প্রশ্ন : আমাদের আমলাতন্ত্র কি নাগরিকবান্ধব রাষ্ট্র গড়ার জন্য প্রস্তুত?
উত্তর : আমাদের নির্বাহী বিভাগ, বিশেষ করে আমলাতন্ত্র এবং পুলিশ ঔপনিবেশিক অতীতের অবশেষ। এ আমলাতন্ত্র সৃষ্টি করেছিল বেসরকারি কোম্পানিÑ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের রাজস্ব আদায়ের জন্য, পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক ব্রিটেনের অর্থভা-ার গড়ে তোলার জন্য। এরাই পাকিস্তান আমলে রূপান্তরিত হয় সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসে এবং ‘সুপিরিয়র’ কিংবা সর্বোচ্চ শ্রেণী হিসেবে নিজেদের জাহির করে! স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পরও জনগণের সেবায় তাদের স্বভাবের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, যদিও তাদের আলঙ্কারিক নাম ‘সিভিল সার্ভিসে’ দাঁড়ায়। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর ১৮৬১ সালের এক নিপীড়ক আইন দ্বারা পুলিশ বাহিনী গড়ে ওঠে এবং এখনও ওই আইন দ্বারাই পুলিশ পরিচালিত হচ্ছে। আইনগত কারণেই এ সংস্থাটি এখনও বল প্রয়োগকারী কর্তৃত্বপরায়ণ রয়ে গেছে।
প্রশ্ন : এখানে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতার অবস্থাটি কিরূপ? দেশের অগ্রগতিতে স্থানীয় সরকারের পাশাপাশি আর কি ধরনের কার্যকর উদ্যোগ জরুরি বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : বাংলাদেশ এখন কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে রয়েছে। এখানে জয়ী পক্ষই সর্বদা সব দখলে রাখে। স্থানীয় পর্যায়ে সরকারের অনুপস্থিতিতে নাগরিকদের সেবাপ্রাপ্তি প্রকটরূপ ধারণ করে। যদিও সরকারের রয়েছে প্রশাসনিক অনেক বিভাগ এবং বেশ কিছু স্তর; কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে সরকার নেই। সরকার যে পর্যায়েরই হোক, তার ন্যূনতম কতক কার্যাবলি থাকতে হয়। ওই কার্যাবলি পালন করলে তাকে সরকার বলা যাবে। যেমনÑ আইনসভা বা আইন প্রণয়ন কার্যাবলি থাকতে হবে, অধীনস্থ পুলিশ থাকবে, যা জানমালের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে এবং আমলাতন্ত্র জনসেবা যথা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গৃহায়ন, যোগাযোগ, সামাজিক নিরাপত্তা এবং অন্যান্য জনসুবিধা প্রদান করবে। অতএব স্থানীয় পর্যায়ে সরকার নেই। এ অবস্থার বদল জরুরি। আমাদের ‘নতুন সামাজিক চুক্তি’ প্রয়োজন, যাতে করে যে যার অবস্থানে থেকে নিজ নিজ ভূমিকা পালন করতে পারে। অর্থাৎ কেন্দ্রীকরণ রোধে স্থানীয় পর্যায়ে সরকার ব্যবস্থা প্রচলন অতীব জরুরি।
স্থানীয় পর্যায়ের মতো একই অবস্থা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। বাংলাদেশ বিশ্বের গুটিকয়েক রাষ্ট্রের মতো ভূ-কৌশলগত রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থলে অবস্থান করছে এবং বর্তমান বৈশ্বিক আর্থরাজনৈতিক সমীকরণ চলছে, কৌশলগত পুনর্বিন্যাস হচ্ছে। কিন্তু ‘সুষম স্বকীয় উন্নয়নধর্মী কূটনীতি’ বেগবান করার নেই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা। একটি জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল কিংবা সমরূপ কাঠামো গড়ে তোলা যেতে পারে। তা হবে সংসদের কাছে জবাবদিহিমূলক একটি সাংবিধানিক সংস্থা। সুবিবেচনাপ্রসূত বিদেশ ও প্রতিরক্ষানীতির জন্য এখন তা অত্যাবশ্যক। এ প্রতিষ্ঠান সার্বভৌমত্ব ও অধিকতর জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করবে।
প্রশ্ন : রাজনৈতিক অচলাবস্থার একটি স্থায়ী সমাধান কি সম্ভব নয়?
উত্তর : আমি এ পর্যন্ত যা বলে এসেছি, এর অন্তর্নিহিত অর্থ হলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচিত সংসদ দ্বারা একটি নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন। অনুবর্তী প্রশ্ন হলোÑ এটা কি সম্ভব? বাংলাদেশের পথচলার একটি রেকর্ড রয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ভারতের ২, পাকিস্তান আমলের ৩ থেকে বাংলাদেশে ১০-এ পৌঁছেছে। ১১ দফা থেকে ৬ দফার আন্দোলনের অভিমুখ পেরিয়ে, শেষাবধি ১ দফায় পরিণত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশÑ বাংলাদেশ, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কর্তৃত্ববাদী পাকিস্তান সরকারকে পরাভূত করে স্বাধীন হয়েছে। পরবর্তী আন্দোলনে জনগণ একদলীয় জনতুষ্টিবাদী কর্তৃত্ববাদ এবং সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এ আন্দোলনের একটি ইতিবাচক দিক ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর শাসকগোষ্ঠীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় খাড়া ও সক্রিয় ভূমিকা। আর একটি নেতিবাচক ফল হলো চক্রাকার প্যাটার্নের অনাকাক্সিক্ষত দিক, নির্বাচনের প্রতি চার বছর পর সংঘাতে জড়িয়ে পড়া। জনগণের সরব সক্রিয়তায় সব শক্তির সম্মিলনে নাগরিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান নিশ্চিত হতে পারে; তবেই নাগরিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’এর চেয়ারপারসন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের শিক্ষক, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে অর্থনীতি পড়ান। তিনি শিক্ষা, সরকার ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সংগঠন, বেসরকারি খাত ও মিডিয়া নিয়ে কাজ করেন। চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা, নাগরিকের ক্ষমতা ও অধিকার, আমলাতন্ত্র ও স্থানীয় সরকার বিষয়ে কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফকরুল চৌধুরী
প্রশ্ন : দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
উত্তর : প্রত্যেক সৎ অভিপ্রায়বিশিষ্ট নাগরিকমাত্রই চায় দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অসুস্থতার অবসান হোক। আমাদের দেশের বাইরের শুভাকাক্সক্ষীরাও তা চায়। সবাই চায় বাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ লাভ করুক। কিন্তু জটিল অস্থিতিশীলতা আমাদের অর্জনের পথে এমন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে, এর থেকে উত্তরণের টেকসই সমাধান দুরূহ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ও শাসনপ্রক্রিয়ার অভিনব কপট রীতিনীতি প্রতিপক্ষকে অস্বীকার করে চলছে এবং গুরুতর সঙ্কটকে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বলে কানাগলিতে নিয়ে নিঃশঙ্ক দেখাতে সচেষ্ট। শুধু তাই নয়, গভীরে প্রোথিত সঙ্কটকে পুরুষতান্ত্রিকতার ছদ্মবেশে দুই ‘যুদ্ধংদেহী বেগম’ এর মধ্যকার কাজিয়া হিসেবে বিবেচনা করে খারিজ করে দেয়ারও এক ধরনের প্রয়াস লক্ষণীয়। দেখা যায়, কেউ কেউ বেপরোয়া এ পরিস্থিতির মধ্যে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রের’ নজির খুঁজছেন; আবার কেউ নিজ দলীয় অবস্থানের কূপে আশ্রয় নিয়ে শুধু নির্বাচনের মধ্যে এ সঙ্কটকে সীমাবদ্ধ করে রাখেন। মূলত স্বার্থীয় অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে সমর্থকরা মনগড়া অভিমত দিয়ে চলছেন। অন্যদিকে মূল সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। এভাবে আসলে আমাদের জাতীয় বৈরিতা ও বিভক্তির প্রকাশ ঘটছে।
প্রশ্ন : রাজনৈতিক সংঘাত আমাদের দেশে নতুন নয়। তবে এত সময় নিয়ে স্থবিরতা কখনও নেমে আসেনি। এ সঙ্কটের উৎস কোথায় বলে মনে করেন?
উত্তর : রাজনৈতিক সংঘাত ও ক্রোধে এরই মধ্যে শতাধিক লোক মারা গেছেন। এরা মারা গেছেন পেট্রলবোমার আগুনে পুড়ে, মারা গেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এবং আন্তঃদলীয় সংঘর্ষে। এক হাজারের অধিক গাড়িতে অগ্নিসংযোগ হয়েছে, বিভিন্ন সময় রেলপথ থেকে প্লেট সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এখনও ঢাকা মেডিকেল কলেজ বার্ন ইউনিটে ঝলসে যাওয়া প্রচুর লোক মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। আন্দোলনকারী বিরোধী দলের হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে; তাদের বেশিরভাগ নেতা হয় জেলে কিংবা আত্মগোপনে আছেন। অনেক নেতাকেই বহুসংখ্যক ফৌজদারি মামলার মাধ্যমে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা হয়েছে। অথচ সমস্যার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। বলা যায়, সঙ্কটের মূলের সূক্ষ্মতা উপলব্ধির ব্যর্থতার কারণেই সমস্যা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্কট এবং জনগণের ক্ষমতায়নের কমতির ফলেই সৃষ্টি হচ্ছে মানবীয় দুর্গতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ইত্যাদি। এ অবস্থা বলবৎ থাকলে চরমপন্থার উত্থানের পথ তৈরি হবে, যা দেশের অস্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘকালীন আর্থরাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষয়ক্ষতি বয়ে আনবে।
![]() |
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর |
উত্তর : রাজনৈতিক অস্থিরতা বন্ধে মিডিয়া যে অবস্থান গ্রহণ করেছে, তা আমি সঠিক মনে করি। তারা বলছেন, নিরপরাধ শিশু ও নারী, মা ও বাবাকে আগুনের ঝলসানো থেকে রক্ষা করুন। এমন একটি ভয়শূন্য পরিবেশ নিশ্চিত করা হোক যেখানে ছাত্রছাত্রী নিঃশঙ্কে তাদের স্বপ্ন এগিয়ে নেবে, কৃষক নির্বিঘেœ চাষাবাদ করবে, শ্রমিকরা কাজ করতে পারবে, যানবাহন সচল থাকবে, কারখানা চালু থাকবে, ব্যবসায় তেজিভাব থাকবে। রাষ্ট্রের কাছে এ ধরনের স্বাভাবিক কাম্যতা প্রত্যেক নাগরিকেরই প্রত্যাশিত। কিন্তু কার্যকর গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, যা চলমান স্থবিরতার মূল কারণ, উপরন্তু তা নাগরিকের অধিকারেও সঙ্কট তৈরি করেছে। এ অবস্থা জনগণের জন্য বড় ধরনের অস্বস্তি তৈরি করেছে, ফলে তাদের জীবন, স্বাধীনতা, স্বাস্থ্য, সর্বোপরি কল্যাণমূলক সবকিছুতেই ন্যূনতম প্রাপ্তিও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
২৫ বছর ধরে আমরা লক্ষ্য করছি, নির্বাচনের চতুর্থ বছরের পর সংঘাত যেন একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। জাতীয় সংসদ আক্ষরিক অর্থে এখন পর্যন্ত কার্যকারিতার প্রকাশ ঘটাতে পারেনি; প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি পদচিহ্ন। অধিকাংশ অধিবেশনে বিরোধী দলের নিয়মিত বয়কট যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। সংসদ সদস্যরা বেশিরভাগ সময়ই তাদের মূল দায়িত্বের বাইরের বিষয় নিয়ে নিমগ্ন থাকেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতির মূল সঙ্কটই প্রতিফলিত হয়, একইসঙ্গে নাগরিক ক্ষমতায়নের হ্রাসপ্রাপ্তি উন্মোচিত হয়। এক্ষেত্রে নাগরিকের ভোটাধিকার হরণ একটি দৃশ্যমান উপদ্রবের নজির। আমরা দেখছি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার উদগ্রী বাসনা, আবার সহিংসতার মাধ্যমে ক্ষমতার উৎপাটন করার তীব্র আকাক্সক্ষা, কোনোরূপ সার্বিক নির্বাচন ব্যতিরেকেই এসব চলছে। নিঃসন্দেহে এগুলো জনগণের জন্য ক্ষমতার চর্চা নয়! আবার ক্ষমতা প্রয়োগে নাগরিকের জন্য কোনো সুযোগও তিরোহিত থাকছে। নাগরিক অধিকার ও ক্ষমতার অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রের বড় ধরনের অধঃপতন ঘটে। ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টমাস হবসের মতে, ‘ক্রমাগত ভয় এবং নৃশংস মৃত্যুর বিপদ এবং মানুষের জীবন, সংহতি, দরিদ্র, জঘন্য, পাশবিক ও হীন করে তোলে।’
প্রশ্ন : নাগরিকের সঙ্গে অধিকারের সম্পর্কটি কিরূপ? নাগরিক ক্ষমতায়নের পরিস্থিতি নিয়ে কিছু বলুন?
উত্তর : ‘নাগরিক’ শব্দটির রয়েছে বেশ কিছু সহজাত অর্থ। তবে এর সহজ একটি মানে হলোÑ ব্যক্তি ন্যূনতম কিছু স্বাধীনতা ভোগ করবে। নাগরিক অধিকার একজন ব্যক্তিকে করে তোলে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী, রাষ্ট্র তার ওপর জ্ঞাপন করে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার। উদারপন্থীরা ‘নেতিবাচক স্বাধীনতা’র সমর্থক; তারা মনে করেনÑ হস্তক্ষেপমুক্ত অধিকার, প্রতিবন্ধকতার অবসান এবং অন্যের কোনো ক্ষতিসাধন নয়। সুতরাং নাগরিকত্ব ও অধিকার বলা যায় হাত ধরাধরি করে চলে এবং তা অবিচ্ছেদ্য ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্যই পরম।
এখন যদি আমরা বাংলাদেশের দিকে তাকাই, তাহলে কি বলা যাবে, এখানে কি নাগরিকরা যথেষ্ট ক্ষমতায়িত হতে পেরেছে? তারা কি স্বাচ্ছন্দ্যে ভোটের স্বাধীনতা উপভোগ ও চর্চা করতে পারছে? পারছে কি মুক্তভাবে চিন্তাভাবনা, বক্তৃতা, অভিব্যক্তি, সমিতি, সমাবেশ ও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে? আরও মৌলিকভাবে বলতে গেলে, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য আমরা কি অন্যের সঙ্গে ইতিবাচক সামাজিক ও সমবায়ী সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষমতা দেখাতে পারছি? আমরা মানবীয় প্রজাতি, অবশ্যম্ভাবীরূপে সামাজিক জীব হিসেবে কি পারছি ইতিবাচক ধারায় টেকসই সামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমে সক্ষমতা অর্জন নিশ্চিত করতে? এসব প্রশ্নের উত্তর সুখকর নয়।
প্রশ্ন : তাহলে কি বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি নাগরিক রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হয়নি?
উত্তর : এ প্রশ্ন আরও কিছু ধারাবাহিক প্রশ্নের অবতারণা দাবি করে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র কি নাগরিক রাষ্ট্র হওয়ার চেষ্টা করেছে? রাষ্ট্র কি অংশগ্রহণের ব্যাপ্তি, রাজনৈতিক সমতা, আধিপত্যের বিরুদ্ধে সুরক্ষা এবং নাগরিক ও রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন দৃঢ়করণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে? তাত্ত্বিক জটিলতায় না গিয়ে আমরা বলতে পারি, রাষ্ট্র হলো এর নাগরিকের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, এটা সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে গাঁটছড়া বাঁধা, এ বিমূর্ত সংগঠনটি সংবিধানের মাধ্যমে বাস্তবাকৃতি পেয়ে থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে জনগণের শত শত বছরের নিরন্তর সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়। তাদের প্রত্যাশা ছিল জনরাষ্ট্রের, ওই জনরাষ্ট্র নিশ্চিত করবে ‘সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামজিক ন্যায়বিচার’। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে এ অঙ্গীকার ঘোষিত হয়েছে। আমাদের মধ্যে কি কোনো সামাজিক চুক্তি হয়েছেÑ বাস্তবে আমাদের সংবিধানে সেসব অপরিহার্য নীতির যথার্থ প্রতিফলন হয়েছে কি? আমাদের এখানে কি রিপ্রেজেন্টেশনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি গড়ে উঠেছে, যেখানে নাগরিকের ইচ্ছা ও বৈচিত্র্যের প্রতিফলন ঘটেছে? আমরা কি জনরাষ্ট্রের শর্তগুলো আদৌ পূরণ করেছি? আমাদের কি এমন কোনো কার্যকরী প্রতিষ্ঠান, কাঠামো ও ব্যবস্থা রয়েছে, যেগুলো দেশে-বিদেশে আমাদের আগামী দিনের কৌশলগত স্বার্থ সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করবে? এখানে গভীর অনুসন্ধানের বিষয় রয়েছে অন্ততপক্ষে বর্তমানের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ও সাংগঠনিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতা উন্মোচন অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। অধিকন্তু রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রের অঙ্গগুলো, প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগ ইত্যাদির অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের মধ্যে প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁজতে হবে। এরপরই নাগরিকবান্ধব রাষ্ট্রের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। এর জন্য নিঃসন্দেহে ব্যাপকভিত্তিক পরিবর্তন আবশ্যক হয়ে উঠবে।
প্রশ্ন : দেশে সম্পদ নিয়ে দুর্বৃত্তায়ন ঘটছে। এর পেছনে রাজনৈতিক প্রশ্রয় কিংবা শাসন ব্যবস্থার সংস্রব রয়েছে কি?
উত্তর : সুস্পষ্ট কিছু কারণে বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পদের আদিম পুঁজিভবন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ প্রক্রিয়ায় সম্পদ আহরণে ক্ষমতা ও জবরদস্তির দেদার ব্যবহার হচ্ছে। ক্লায়েন্টালিস্ট রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এসব ক্লায়েন্টালিস্ট সম্পদনির্ভর নেটওয়ার্ক উল্লম্ব স্তরে (স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে) একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। অনুরূপ আনুভূমিকভাবে ব্যবসা, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার ব্যবস্থার কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কিত। যেমনÑ মিডিয়া প্রচুর প্রতিবেদন প্রকাশ করছে, রাজনৈতিক দলের নেতারা ক্যাডার ও মাস্তান পুষে জনগণের সম্পদ দখলচ্যুত করছে, নিরীহ মানুষের সম্পদ লুটতরাজ করছে। মিডিয়া বলছে, পুলিশ সাধারণত বেআইনি কাজের জন্য শাসক দলের নেতা বা ক্যাডারদের গ্রেফতার করে না, কারণ তারা সরকারের আসকারা পেয়ে থাকে। প্রশাসনও দূরে থাকে, কারণ তারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আনুকূল্য পায়। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতির নেতা শাসকগোষ্ঠীর সমর্থন নিয়ে নেতৃত্বে আসীন হয়ে থাকেন। সম্পদের দখলদারি রাখতে শুধু মধ্যবর্তী শ্রেণীগুলোর মধ্যেই রেষারেষি চলে না, এর মধ্য থেকে রাজনীতির বোঝাপড়াও স্থির হয়ে থাকে। মোটাদাগে মধ্যবর্তী শ্রেণীগুলোয় অন্তর্ভুক্ত হলো ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কৃষক, শহুরে পেটি-বুর্জোয়া এবং শিক্ষিত শ্রেণী। এ মধ্যবর্তী শ্রেণীগুলোর অন্তর্ভুক্ত নয় মজুর, গরিব কৃষক এবং শিক্ষিত বেকার। তবে মধ্যবর্তী শ্রেণীগুলো তাদের বাইরের অধিকাংশ মানুষ থেকে সাংগঠনিকভাবে বেশ মজবুত। এ প্রক্রিয়াটি প্রকৃত এলিট কিংবা বুর্জোয়া শ্রেণী গঠনে সঙ্কট তৈরি করছে এবং আইনভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠছে না।
প্রশ্ন : সর্বত্র যেখানে নাগরিক অধিকার সঙ্কুচিত, সেখানে নাগরিক ক্ষমতা সংরক্ষণের উপায়টি কীভাবে হবে?
উত্তর : বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক অধিকার এবং জনপর্যায়ের প্রধান অন্তরায় হলো রিপ্রেজেন্টেশন বা প্রতিনিধিত্বের অভাব ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ। বাংলাদেশে যেভাবে ভোটের অধিকার হরণ বহাল আছে, যদিও এটাকে ছায়াচ্ছন্ন যুক্তি এবং ক্ষমতার একাধিপত্যের মাধ্যমে বৈধতা দেয়ার উদ্যমের কমতি নেই। এ পরিস্থিতিতে সাধারণ নাগরিকরাই প্রকৃতপক্ষে নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠতার মধ্যে অবস্থান করছেন, তারা তিনটি ইস্যুতে রিপ্রেজেন্টেশনের বিন্যাস পরিবর্তনের জন্য আলোচনা করতে পারেনÑ প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়া, আইন প্রণেতাদের এখতিয়ার এবং নির্বাচন পরিচালনার সংগঠন। এ তিনটি ক্ষেত্রে যথেষ্ট সংস্কার হলে অবশ্যই ক্ষমতার কেন্দ্রীভুবন থেকে দূরে সরে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। এক্ষেত্রে বর্তমান ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ বা এলাকাভিত্তিক এক ব্যক্তি এক ভোট ব্যবস্থা নিয়ে পুনর্ভাবনায় যেতে হবে, এখানে দেখা যায় ন্যূনতম ভোট পেয়ে সর্বোচ্চ আসন জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আনুপাতিক ভোটের মিশ্র পদ্ধতির সমন্বয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা যেতে পারে। সে সঙ্গে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা করা যেতে পারে এবং উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচনে ঘূর্ণায়মান ব্যবস্থা থাকতে পারে। উচ্চকক্ষে নিশ্চিত করা যেতে পারে সমাজের বিভিন্ন পেশা ও শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধিত্ব। এ নির্বাচিত উচ্চকক্ষের দলনিরপেক্ষ সংসদ সদস্য সমন্বয়ে প্রত্যক্ষ ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচনকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে। ফলে ব্যাপক অংশগ্রহণের যেমন পরিধি বাড়বে, তেমনি একাধিপত্য সীমাবদ্ধ হবে। দৃশ্যত নিষ্ফল সংসদ। তবে সংসদ সদস্যরা আর্থিক ও অ-আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেই অত্যুৎসাহী। এ বিষয়টি সঠিক মাত্রায় পরিহার করা সম্ভব, যদি সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স সম্পন্ন করতে পারে এবং সরকারের নির্বাহী বিভাগের ওপর সংসদের ওভার সাইট ক্ষমতা থাকে। সংসদ সদস্যের বিশেষ অধিকার আইন যেমন দরকার; একইভাবে দায়বদ্ধতার জন্য তাদের আচরণবিধি প্রণয়ন প্রয়োজন। প্রয়োজন রাজনীতির অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার আইন। সংবিধানে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এমন বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে, যাতে করে নির্বাচন কমিশন সামগ্রিকভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় পুরোপুরি দায়বদ্ধ থাকবে। তাহলে শাসন প্রক্রিয়ায় জনগণ অংশগ্রহণের একটি ক্ষেত্র পাবে। তারা ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ পাবে।
প্রশ্ন : আমাদের আমলাতন্ত্র কি নাগরিকবান্ধব রাষ্ট্র গড়ার জন্য প্রস্তুত?
উত্তর : আমাদের নির্বাহী বিভাগ, বিশেষ করে আমলাতন্ত্র এবং পুলিশ ঔপনিবেশিক অতীতের অবশেষ। এ আমলাতন্ত্র সৃষ্টি করেছিল বেসরকারি কোম্পানিÑ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের রাজস্ব আদায়ের জন্য, পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক ব্রিটেনের অর্থভা-ার গড়ে তোলার জন্য। এরাই পাকিস্তান আমলে রূপান্তরিত হয় সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসে এবং ‘সুপিরিয়র’ কিংবা সর্বোচ্চ শ্রেণী হিসেবে নিজেদের জাহির করে! স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পরও জনগণের সেবায় তাদের স্বভাবের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, যদিও তাদের আলঙ্কারিক নাম ‘সিভিল সার্ভিসে’ দাঁড়ায়। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর ১৮৬১ সালের এক নিপীড়ক আইন দ্বারা পুলিশ বাহিনী গড়ে ওঠে এবং এখনও ওই আইন দ্বারাই পুলিশ পরিচালিত হচ্ছে। আইনগত কারণেই এ সংস্থাটি এখনও বল প্রয়োগকারী কর্তৃত্বপরায়ণ রয়ে গেছে।
প্রশ্ন : এখানে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতার অবস্থাটি কিরূপ? দেশের অগ্রগতিতে স্থানীয় সরকারের পাশাপাশি আর কি ধরনের কার্যকর উদ্যোগ জরুরি বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : বাংলাদেশ এখন কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে রয়েছে। এখানে জয়ী পক্ষই সর্বদা সব দখলে রাখে। স্থানীয় পর্যায়ে সরকারের অনুপস্থিতিতে নাগরিকদের সেবাপ্রাপ্তি প্রকটরূপ ধারণ করে। যদিও সরকারের রয়েছে প্রশাসনিক অনেক বিভাগ এবং বেশ কিছু স্তর; কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে সরকার নেই। সরকার যে পর্যায়েরই হোক, তার ন্যূনতম কতক কার্যাবলি থাকতে হয়। ওই কার্যাবলি পালন করলে তাকে সরকার বলা যাবে। যেমনÑ আইনসভা বা আইন প্রণয়ন কার্যাবলি থাকতে হবে, অধীনস্থ পুলিশ থাকবে, যা জানমালের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে এবং আমলাতন্ত্র জনসেবা যথা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গৃহায়ন, যোগাযোগ, সামাজিক নিরাপত্তা এবং অন্যান্য জনসুবিধা প্রদান করবে। অতএব স্থানীয় পর্যায়ে সরকার নেই। এ অবস্থার বদল জরুরি। আমাদের ‘নতুন সামাজিক চুক্তি’ প্রয়োজন, যাতে করে যে যার অবস্থানে থেকে নিজ নিজ ভূমিকা পালন করতে পারে। অর্থাৎ কেন্দ্রীকরণ রোধে স্থানীয় পর্যায়ে সরকার ব্যবস্থা প্রচলন অতীব জরুরি।
স্থানীয় পর্যায়ের মতো একই অবস্থা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। বাংলাদেশ বিশ্বের গুটিকয়েক রাষ্ট্রের মতো ভূ-কৌশলগত রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থলে অবস্থান করছে এবং বর্তমান বৈশ্বিক আর্থরাজনৈতিক সমীকরণ চলছে, কৌশলগত পুনর্বিন্যাস হচ্ছে। কিন্তু ‘সুষম স্বকীয় উন্নয়নধর্মী কূটনীতি’ বেগবান করার নেই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা। একটি জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল কিংবা সমরূপ কাঠামো গড়ে তোলা যেতে পারে। তা হবে সংসদের কাছে জবাবদিহিমূলক একটি সাংবিধানিক সংস্থা। সুবিবেচনাপ্রসূত বিদেশ ও প্রতিরক্ষানীতির জন্য এখন তা অত্যাবশ্যক। এ প্রতিষ্ঠান সার্বভৌমত্ব ও অধিকতর জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করবে।
প্রশ্ন : রাজনৈতিক অচলাবস্থার একটি স্থায়ী সমাধান কি সম্ভব নয়?
উত্তর : আমি এ পর্যন্ত যা বলে এসেছি, এর অন্তর্নিহিত অর্থ হলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচিত সংসদ দ্বারা একটি নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন। অনুবর্তী প্রশ্ন হলোÑ এটা কি সম্ভব? বাংলাদেশের পথচলার একটি রেকর্ড রয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ভারতের ২, পাকিস্তান আমলের ৩ থেকে বাংলাদেশে ১০-এ পৌঁছেছে। ১১ দফা থেকে ৬ দফার আন্দোলনের অভিমুখ পেরিয়ে, শেষাবধি ১ দফায় পরিণত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশÑ বাংলাদেশ, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কর্তৃত্ববাদী পাকিস্তান সরকারকে পরাভূত করে স্বাধীন হয়েছে। পরবর্তী আন্দোলনে জনগণ একদলীয় জনতুষ্টিবাদী কর্তৃত্ববাদ এবং সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এ আন্দোলনের একটি ইতিবাচক দিক ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর শাসকগোষ্ঠীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় খাড়া ও সক্রিয় ভূমিকা। আর একটি নেতিবাচক ফল হলো চক্রাকার প্যাটার্নের অনাকাক্সিক্ষত দিক, নির্বাচনের প্রতি চার বছর পর সংঘাতে জড়িয়ে পড়া। জনগণের সরব সক্রিয়তায় সব শক্তির সম্মিলনে নাগরিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান নিশ্চিত হতে পারে; তবেই নাগরিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’এর চেয়ারপারসন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের শিক্ষক, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে অর্থনীতি পড়ান। তিনি শিক্ষা, সরকার ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সংগঠন, বেসরকারি খাত ও মিডিয়া নিয়ে কাজ করেন। চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা, নাগরিকের ক্ষমতা ও অধিকার, আমলাতন্ত্র ও স্থানীয় সরকার বিষয়ে কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফকরুল চৌধুরী
No comments:
Post a Comment