Friday, February 27, 2015

নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা ও ইতিহাস চর্চার গতিমুখ

আজিজুল রাসেল

১৯৮২ সালে প্রথম যখন নিম্নবর্গের ইতিহাস সংকলন বের হয়, তখন সারস্বত সমাজে আলোচনা-সমালোচনার ঢেউ বয়ে যায়। আলোচনা যত হয়েছিল, সমালোচনা হয়েছিল এর কয়েকগুন বেশি। পণ্ডিতমহলে নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার পদ্ধতি নিয়েও কম কথা ওঠেনি। সমালোচনা এসেছিল জ্ঞান চর্চার সব মার্গ থেকেই। ইতিহাস চর্চার সাম্রাজ্যবাদী ঘরানা যেমন এর কড়া সমালোচনা করেছিল, জাতীয়তাবাদী ঘরানাও সেই একই কাজ করে। এমনকি কট্টর মাকসবাদীরাও নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চাকে ভালো চোখে নেয়নি। তবে একটি কথা কোনভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, নিম্নবর্গের ইতিহাস ইতিহাস তত্ত্বে ও চর্চায় একটি বড় পরিবর্তন এনেছে। প্রথাগত ইতিহাস চর্চার ধারায় একটি বড় ধাক্কা দেয় নিš§বর্গের ইতিহাস চর্চাগোষ্ঠী; পূর্ববর্তী ইতিহাস চর্চার সব ঘরানার আবির্ভাব পাশ্চাত্য থেকে। পাশ্চাত্যের তথ্যেই বিশ্বজুড়ে নির্মিত হত ইতিহাস। নিম্নবর্গের ইতিহাস সেক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের ইতিহাস তত্ত্বের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়।
যুগ যুগ ধরে যে ‘পাশ্চাত্য’ ধারণা পোষণ করে এসেছে এবং সৃষ্টি করে যে- প্রাচ্য অর্থাৎ এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলো অনঢ়, স্থবির, অচল-অপরিবর্তনীয়।১ নতুন কিছু এই অঞ্চল থেকে হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু পাশ্চাত্যের এই ডিসকোর্সে নুনের ছিটা দিয়ে দিয়েছে নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চাকারীরা। পাশ্চাত্য ‘তৃতীয় বিশ্বের’ আখ্যা দিয়েছে যে অঞ্চলকে সেই ‘তৃতীয় বিশ্ব’ থেকেই এমন ইতিহাস তত্ত্ব খাড়া হয়েছে যা উপনিবেশবাদী, পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ডিসকোর্সকে তোপের মুখে ফেলেছে। ইতিহাসে চিরবঞ্চিত নিম্নবর্গকে রিপ্রেজেন্ট করেছে তার আঙিনায়। আবেগ দিয়ে এই নির্মাণ নয়, তাত্ত্বিকভাবে নির্মাণ, যৌক্তিকভাবে নির্মাণ। সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী এবং জাতীয়তাবাদী উচ্চ বর্গীয় ইতিহাস চর্চাকারীরা সব সময় দেখিয়ে এসেছেন নিম্নবর্গের কৃষক-শ্রমিক শ্রেণীর কোন রাজনৈতিক সচেতনতা নেই। কিন্তু নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চাকারীরা তাদের চর্চিত ইতিহাসে প্রমাণ করেছেন ইতিহাসে নিম্নবর্গের অস্তিত্ব, চৈতন্য, প্রভা এবং একইভাবে সীমাবদ্ধতা। অনেকে হয়তো বলতে পারেন নিম্নবর্গের ইতিহাস সত্তরের দশকে লেখা ‘হিষ্টি ফ্রম বেলো’র অনুকৃতি । এর নতুনত্বটা কি? কথাটা যারা বলবেন, ইতিহাস চেতনায় তাদের সীমাবদ্ধতা আছে। সত্তরের দশকে ক্রিস্টোফার হিল, এডোয়ার্ড টমাস এবং এরিক হবস্বমের ধারা অনুসরন করে তল থেকে ইতিহাস লেখার একটা ধারা প্রচলিত হয়েছিল।২ ইউরোপের যন্ত্রসভ্যতা আর পুঁজি পসারিদের পায়ের তলায় পিষ্ট জনমানুষের কথা তুলে ধরার দাবি  করেছিলেন ‘হিস্ট্রি ফ্রম বেলো’র ইতিহাসবিদরা। কথাটা সত্যি। পদপিষ্ট মানুষের কথা তুলে ধরেছিলেন এই ইতিহাসবিদরা।৩ কিন্তু এই জনমানুষ, শোষিত মানুষের কথা কি তুলে ধরেছিলেন তারা? কতোটা রিপ্রেজেন্ট করেছিলেন তাদের? কিভাবে রিপ্রেজেন্ট করে ছিলেন তারা নিম্নবর্গকে! বিষয়টা একটু খতিয়ে দেখার অবকাশ আছে। তারা যেভাবে প্রদর্শন করেছিলেন শোষিত, নির্যাতিত নিম্নবর্গের কৃষক-শ্রমিক শ্রেণীকে তা হলোÑএই শোষণ অনিবার্য। ইতিহাসে তাদের অবস্থান শুধু শোষিত এবং পিষ্ট হিসেবেই এবং এই শোষন অনিবার্য। তাদের রচিত নিনম্বর্গের ইতিহাসে প্রতিবাদ প্রতিরোধহীন, রাজনৈতিক চেতনাহীন, বাকহীন একজন মানুষ। ক্রন্দসী এই ইতিহাসে নিম্নবর্গ উপস্থাপিত হয়েছে রাজনৈতিক চেতনাহীন জনগোষ্ঠী হিসেবে। আদতে এই ‘হিস্ট্রি ফ্রম বেলো’ও কোন নতুন কাঠামো দাঁড় করাতে পারেনি। হিস্ট্রি ফ্রম বেলো’র অবস্থানও সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী ইতিহাস কাঠামোর ভেতরেই। এ ধারার তাত্ত্বিক গুরু হব্সবমের তত্ত্বও পরিষ্কার সে কথা বলে দেয়। হব্সবম ভারতীয় উপমহাদেশের উপনিবেশ কালের প্রথম দিক্কার কৃষক সংগ্রামগুলোকে বলেছেন প্রাক-রাজনৈতিক।৪ অর্থাৎ এ আন্দোলন সংগ্রামের কোন রাজনৈতিক চেতনা নেই। হব্সবমের এ তত্ত্বের অসারতা প্রমাণ করেছেন সিরাজুল ইসলাম, মুনতাসীর মামুন ও সৈয়দ আনোয়ার হোসেন সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থে।৫ নিম্নবর্গের ইতিহাসকাররা এই ‘হিস্ট্রি ফ্রম বেলো’ থেকে সম্পূর্ন স্বতন্ত্র। আর কেউ যদি বলেন, নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদরা এই ইতিহাস থেকে উদ্দীপনা পেয়েছে, সহযোগিতা পেয়েছে। তাহলে বলব সব ইতিহাসের কাছ থেকেই শেখার আছে। সেক্ষেত্রে ‘হিস্ট্রি ফ্রম বেলো’ কেনো, বুর্জোয়া ইতিহাস তত্ত্ব থেকেও অনেক শেখার আছে ইতিহাসবিদদের। এর ফাঁক-ফোকর, কুট-কৌশল, ফন্দি, এগুলো অবশ্যই নখদর্পণে থাকতে হবে জনমানুষের  পক্ষের একজন ইতিহাসবিদের।


নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার শুরু হয়েছিল, উপনিবেশবাদী, সাম্রজ্যবাদী ও জাতীয়তাবাদী ইতিহাস তত্ত্বের বিরোধিতা দিয়ে। রনজিৎ গুহ,‘সাবলটার্ণ স্টাডিজের’ প্রথম খন্ডের ভূমিকায় সে কথাই ঘোষণা করেন। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাস রচনায় দীর্ঘ দিন ধরে ঔপনিবেশিক উচ্চবর্গ আর বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী উচ্চবর্গের আধিপত্য চলে আসছে, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ও আমেরিকান ইতিহাসবিদেরা যেমন- ভারতীয় জাতীয়বাদী আন্দোলনকে দু®কৃতিকারীদের কর্ম এবং মুষ্টিমেয় মানুষের ক্ষমতা দখলের লড়াই হিসাবে দেখাতে চেয়েছে তেমনি জাতীয়তাবাদীরাও শুধু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে একটি এলিটিস্ট সংগ্রহ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।৬ আন্দোলন সংগ্রামে উচ্চবর্গের ভূমিকারই সাফাই গেয়ে এসেছেন তারা। আর এই ভারতীয় বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ইতিহাস তত্ত্বের আরেক বড় দূর্বলতা হলো এটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে পাশ্চাত্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ইনস্টিটিউশনের ফসল বলার মাধ্যমে শিক্তি মধ্যবিত্ত্ব ও এলিটদের যে ভূমিকার কথা বলেছেন- একইভাবে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে উপনিবেশবাদেরও সাফাই। জাতীয়তাবাদী  ঐতিহাসিকরা পাশ্চাত্য এনলাইটেনমেন্ট ও রেনেঁসার আদলে এখানে যে রেনেঁসার কথা বলেছেন, তা মিথ ছাড়া কিছুই নয় । বিনয় ঘোষ তারবাংলার নবজাগৃতি গ্রন্থের সংযোজন ১৯৭৮-এ ‘বাংলার নবজাগৃতি’কে বলেছেন একটি অতি কথা ছাড়া আর কিছুই নয়। এলিট জাতীয়তাবাদী  ঐতিহাসিকরা রেনেঁসার এই আলোকবর্তিকাদের গুনকীর্ত্তন করে ব্যয় করেছেন পাতার পর পাতা। রাজা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, আমির আলি, সৈয়দ আহমেদ এমন অনেক নবজাগরনের মণীষীদের কথায় জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চাকারীরা ইতিহাসের পাতা করে রেখেছেন ভারাক্রান্ত।* বিনয় ঘোষ বাংলার নবজাগরণ প্রবন্ধে বাংলার নবজাগরণের এই হেয়ালি প্রমাণ করেছেন। বলেছেন তিনি:
‘পন্ডিতেরা উনিশ শতকে বাংলার যে রেনেঁসাস বা নবজাগরণের কথা বলেন, সেটা কি পদার্থ? কোথায় এবং কখন ‘জাগরণ’ হল? জাগল কারা? কলকাতা শহর যদি ‘নবজাগৃতিকেন্দ্রিক’ হয়। যদি রেনোঁসাসের সূর্য ‘জ্যোতির কনক পদ্মের’ মতো কলকাতার আকাশে উদিত হয়ে থাকে, তাহলে কলকাতার খুব কাছাকাছি গ্রামেও, দেড়শো বছর পরেও, কেন অমাবস্যার রাতের মতো অন্ধকার? কেন অতীতের ছেঁড়াকাঁথায় শুয়ে গ্রামের মানুষ আজও গভীর ঘুমে অচৈতন্য।৭
বিনয় ঘোষ ব্যাপারটা ঠিক ধরেছেন। আমাদের জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরা যাদেরকে নবজাগরণের অগ্রদূত বলছেন, তারা কতোটা ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল ভেঙে আলো ছড়াতে পেরেছেন? সত্তর দশকে অশোক সেন, রনজিৎ গুহ, সুমিত সরকার ঐতিহাসিক প্রশ্ন তুলেছিলেন, রামমোহন-বিদ্যাসাগর প্রমুখ মণীষীদের ঐতিহাসিক ভূমিকা প্রগতিশীল কোন অর্থে? তাঁদের সংস্কার-চিন্তা তো ঔপনিবেশিক অর্থনীতি-রাজনীতির সীমানা ছাড়িয়ে এগোতে চেষ্টা করেনি। বস্তুত ব্রিটিশ শাসনের প্রগতিশীলতার ওপর আস্থা রেখেই তো তাঁদের সংস্কার প্রচেষ্টার সীমা। ঔপনিবেশিক ভারতে ক্ষমতার বিন্যাস নিয়ে কোনও মৌলিক প্রশ্ন ‘নবজাগরণ’-এর নায়কেরা তোলেননি, বরং সেই ক্ষমতাবিন্যাসকে অবলম্বন করেই তাঁরা সামাজিক প্রগতি আনার চেষ্টা করেছেন। সে চেষ্টা ব্যর্থ হওয়া অনিবার্য ছিল।৮

        শুধু জাতীয়তাবাদী ইতিহাস কেন, মার্কসবাদীদের ইতিহাসও এই নবজাগরণ এবং নবজাগরণের মনীষীদের জায়গা ছিল গুরুত্ব সহকারে। ছিল বললে ভুল হবে, এখনও মার্কসবাদী রাজনৈতিক দলের অনেকে নবজাগরণের এই মনীষীদের জš§-মৃত্যু ঘটা করে পালন করেন। রাজা রামমোহন, বিদ্যাসাগর সম্পর্কে ভক্তিতে তারা গদগদ। ব্যাপারটা খুলেই বলা যাক- পরিষ্কার করার জন্য। পাঠক লক্ষ্য করবেন,বাংলাদেশের একটি বামপন্থী রাজনৈতিক দল,বাংলাদেশে রামমোহন , বিদ্যাসাগরের জš§-মৃত্যু নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। সেখানে বক্তারা এটা ভেবেও ভক্তিতে আপ্লুত হন- রাজা সাহেব ব্রিষ্টলে যেয়ে মরেছেন। ব্রিষ্টল থেকে মহার্ঘ পাশ্চাত্য শিক্ষা আমদানী করেছেন আমাদের জন্য। শুধু তাই নয় বামপন্থী এই দলটি তাদের রাজনৈতিক প্রকাশনায় বাংলাদেশের উৎপাদন পদ্ধতি ও রাষ্ট্রচরিত্র নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে ঔপনিবেশিক মতাদর্শ প্রকট। দলটি তার প্রকাশনায় বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবী করেছে। তারা তাদের প্রকাশনায় লেনিনের কিছু উক্তিকে না বুঝে স্বেচ্ছাচারে প্রয়োগ করেছে। তারা বলেছে, লেনিনের উক্তিকে উদ্বৃত করে,কোন দেশের কৃষি উৎপাদনের চরিত্র পূুঁজিবাদী কিনা, তা বোঝার প্রধান লক্ষ্য কি, তা নির্দেশ করে লেনিন দেখিয়েছিলেন, কৃষি মজুর নিয়োগ করে চাষ করাই কৃষি
উৎপাদনে পুঁজিবাদের প্রধান লক্ষণ (বাসদ : ১৯৯০ : ঢাকা)।৯ এরপরই দলটি বলছে বাংলাদেশে ভূমিহীন কৃষক যেহেতু অধিক, মানে কৃষি মজুর নিয়োগ হচ্ছে, তাই কৃষিতে পুঁজিবাদি বিপ্লবের প্রমাণ পেয়েছেন। দলটি তার ক্ষুদ্র পুস্তিকাটিতে প্রমাণ করতে চেয়েছে, বাংলাদেশে জাতীয় গনতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে।১০ দলটি বাংলাদেশে যে জাতীয় বুর্জোয়ার কথা বলছে আসলে এই বুর্জোয়াদের চরিত্র কোন অর্থেই জাতীয় নয়। এদেরকে বড়জোর এজেন্ট বলা যায়। এরা জাতীয় পুঁজির বৃদ্ধির পরিবর্তে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর এজেন্ট হিসেবেই কাজ করে। বিপ্লবী তাত্ত্বিক ফ্রান্ৎস ফাঁনোও একই কথা বলেছেন তার বহুল আলোচিত গ্রন্থ ‘দ্যা রেচেড অব দ্য আর্থে’। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, এক সময়ের উপনিবেশিত দেশগুলোয় জাতীয় বুর্জোয়া বিপ্লব হবার সম্ভাবনা নেই।১১ যারা আছে তারা হচ্ছে জাতীয় এজেন্ট। তাই জাতীয় মুক্তির স্বার্থে এই জাতীয় এজেন্টদের বিনাশ করা দরকার। যারা বুর্জোয়া জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলেছেন আদতে তারা সাম্রাজ্যবাদী এজেন্টকেই উর্ধ্বে তুলে ধরছেন। তাছাড়া ঔপনিবেশিক যুগের ভারতের উৎপাদন কাঠামোটা বিশ্লেষণ করলেও আমরা দেখব এখানে কেনো জাতীয় বুর্জোয়া সৃষ্টি হয়নি। কারা বাঁধা সৃষ্টি করছিল এই জাতীয় বুর্জোয়া সৃষ্টিতে? সে কথা ফ্রান্ৎস ফাঁনো বলেছেন তাঁর‘রেচেড অব দ্য আর্থ’ এবং আলাভি তাঁর গবেষণা প্রবন্ধে। উপনিবেশকাররা ঔপনেবেশিত দেশে পুঁজির বিকাশ রুদ্ধ করে তা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মেট্রোপলিটনে আর উপনিবেশে সৃষ্টি করেছিলেন একদল বেনিয়া-মুৎসুদ্দি অর্থনৈতিক শ্রেনী। কার্ল মার্কস ভারতে পুঁজিবাদী বিপ্লব সম্পর্কে যে ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন তা কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে ঘটেনি :

আমি জানি, ব্রিটিশ মিলমালিক শ্রেণী ভারতে রেলপথ নির্মাণে উদযোগী হয়েছে যাতে তাদের কলকারখানার জন্য তুলো ও অন্যান্য কাঁচামাল সরবরাহের সুবিধা হয়। কিন্তু কোনো দেশের মধ্যে যানবাহন ব্যবস্থায় যদি যন্ত্র দানবের আবির্ভাব হয় এবং সেদেশে লোহা ও কয়লা সম্পদ প্রচুর পরিমাণে থাকে, তাহলে সাধ্য কার যে, তার অগ্রগতির পথে বাঁধা সৃষ্টি করে। বিরাট একটা দেশের ভেতরে যদি স্নায়ু মন্ডলীর মতন রেলপথ নির্মাণ করা হয় তাহলে বাধ্য হয়ে সেই রেলপথ চালু রাখার প্রয়োজনে সেদেশে যন্ত্রচালিত কলকারখানাও গড়ে তুলতে হবে। তার সঙ্গে অনিবার্য নিয়মে এমন যন্ত্রশক্তি প্রয়োগ করতে হবে, যার সঙ্গে রেলপথের কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকবে না। সুতরাং একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে রেলপথ ভারতীয় শ্রম শিল্প যুগের অগ্রদূত... রেলপথ বিস্তারের জন্য যেসব আধুনিক শ্রমশিল্পের বিকাশ হবে তার আধুনিক শ্রমশিল্পের বিকাশ হবে তার আঘাতে ভারতের অগ্রগতির পথে অন্তরায়গুলি একে একে দূর হয়ে যাবে, ভারতের বর্ণগোড়ামি, গ্রাম্য সমাজের জড়তা, কূপমন্ডুকবৃত্তি সব ভেঙে যাবে।১২

ভারতীয় সমাজে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা সম্পর্কে একই প্রবন্ধে মার্কস আরও বলেন:

ব্রিটিশ বুর্জোয়া শ্রেণী যা করতে বাধ্য হবে তাতে জনসাধরণের সামাজিক দূরাবস্থার উন্নতি বা মুক্তি হতে পারে না। তার জন্য অর্থনৈতিক উৎপাদন শক্তি জনসাধারণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তাহলেও ব্রিটিশ বুর্জোয়া শ্রেণী যা করতে বাধ্য হবে তাতে আর কিছু না হোক, এই উন্নতি মুক্তি ও শক্তি বৃদ্ধির বাস্তব অবস্থার সৃষ্টি হবেই। ইতিহাসে কোথাও কি বুর্জোয়াশ্রেণী এর চাইতে বেশি কিছু করতে পেরেছে ? ...

ব্রিটিশ বুর্জোয়া শ্রেণী ভারতবর্ষে যে নতুন সমাজব্যবস্থার বীজ ছড়িয়ে দিতে বাধ্য হবে। চারিদিক তার পরিপূর্ণ প্রকাশ একমাত্র তখনই সম্ভব হবে যখন ইংল্যান্ডের মজুরশ্রেণী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে, অথবা যখন ভারতের জনসাধারণ নিজেরা সংগ্রাম করে ব্রিটিশের অধীনতা থেকে মুক্ত হবে।১৩

       পাঠক ক্ষমা চাচ্ছি এত দীর্ঘ উদ্ধৃতির জন্য। উদ্ধৃতি দু’টি খুবই প্রাসঙ্গিক। উদ্ধৃতি দু’টি না দিলে আমি যে বক্তব্যটি উপস্থাপন করতে চাইছি তা সম্ভব হতো না। অন্য পক্ষে মার্কসকে উদ্ধৃত করা হতো খন্ডিতভাবে। যে কথাটি বলতে চাইছি, তা হলো কার্ল মার্কস ব্রিটিশ শাসনের অনিবার্য যে অভিঘাত-অর্থনীতিতে পুূঁঁজিবাদের উদ্ভবের কথা বলেছিলেন, তা কিন্তু হয়নি। বরঞ্চ ব্রিটিশ শাসন ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাভাবিক উপাদন কাঠামোর অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। সৃষ্টি করেছিল একটি বিকৃত উৎপাদন ব্যবস্থা। হামাজা আলাভী ও বানাজী তার চরিত্র বিশ্লেষণ করে একে সজ্ঞায়িত করেছেন ঔপনিবেশিক উৎপাদন কাঠামো বলে। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনও উনিশ শতকে পূর্ব বাংলার সমাজ গঠন ব্যাখ্যা করতে যেয়ে আলাভী বর্ণিত উৎপাদন কাঠামো দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন।১৪ আলাভী সোশ্যাল রেজিস্টারে তার একটি পান্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন এই উৎপাদন ব্যবস্থা পুঁজিবাদের মতো দেখতে হলেও তা পুঁজিবাদী নয়। পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হিসেবে তিনি বলেছেন ১. স্বাধীন শ্রম যা সামন্তদায় থেকে মুক্ত। মরিস ডবের ভাষায় এটি এমন একটি ব্যবস্থা যার অধীনে শ্রমশক্তি নিজেই পরিণত হয় পণ্যে এবং অন্যান্য পণ্যের মতই বাজারে বেচাকেনা হয়। স্বাধীন শ্রমকে আরেকভাবে দেখা যেতে পারে, তা হলো যখন উৎপাদক উৎপাদনের উপাদান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ২. উদ্ধৃত্ত আত্মসাতকরণে অর্থনৈতিক জবরদস্তি-অর্থাৎ মজুর যখন তার উৎপাদনের উপাদান (যেমন- জমি, যন্ত্রপাতি) থেকে উৎখাত হয় তখন তার থাকে শুধুমাত্র শ্রমশক্তি। সে তখন প্রত্যক্ষ উৎপাদক এবং স্বাধীনও বটে। কিন্তু তাকে বেঁচে থাকতে হয় তাঁর শ্রমশক্তি বিক্রি করে নচেৎ বেঁছে নিতে হয় উপবাসে মৃত্যুর পথ। ৩. ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক( শ্রেণী) ক্ষমতা থেকে রাজনৈতিক(রাষ্ট্র)ক্ষমতার বিচ্ছিন্নকরণ। সৃষ্টি হয় বুর্জোয়া রাষ্ট্রের এবং প্রচলিত হয় বুর্জোয়া আইন, বিশেষ করে ভূমি সম্পর্কে ধনবাদী উৎপাদন পদ্ধতির প্রধান চরিত্র : অবাধ বাণিজ্যের মত বুর্জোয়া আদর্শ। ৪. সাধারণকৃত পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা যে ক্ষেত্রে উৎপাদন হচ্ছে প্রত্যক্ষভাবে পণ্য উৎপাদন অর্থাৎ কিনা বাজারে বিক্রির মাধ্যমে মূল্যের উসুল এবং যে ক্ষেত্রে শ্রমশক্তি হচ্ছে পণ্য বিশেষ। অর্থাৎ বাজারের জন্যেই প্রাথমিকভাবে পণ্য বাজারে তার বিনিময় হয়। ৫. মূলধনের বিস্তৃত পুনরুৎপাদন: উদ্ধৃত্ত্ব এক্ষেত্রে প্রধানত ব্যবহƒত হয় পুঁজি সঞ্চয় এবং উৎপাদনের শক্তি নিচয় ও কৃৎকৌশলের অগ্রগতি বিস্তৃতির জন্য। ইতিহাসবিদ হামজা আলাভী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের উৎপাদন কাঠামোকে নতুন একটি উৎপাদন কাঠামো হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যা নয় সামন্তবাদী আবার নয় পুঁজিবাদী । আলাভী বলেন, এটি একটি বিকৃত উৎপাদন কাঠামো, যার নাম দেন তিনি ঔপনিবেশিক উৎপাদন কাঠামো। আলাভী বলেন, এই উৎপাদন কাঠামোর চরিত্র পুঁজিবাদী দেখালেও শেষের দু’টি বৈশিষ্ট্য সরল পণ্য উৎপাদন ও বিস্তৃত পুনরুৎপাদনে ঔপনিবেশিক রূপ লাভ করে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে যেমন মূলধনের বিস্তৃত পুনরুৎপাদন হয়, তেমনি হয় পুঁজি সঞ্চয়। উৎপাদনের শক্তি এবং কৃৎকৌশলের বিস্তৃতির জন্য ব্যয় হয়, এখানে তা হয় না। পুঁজি চলে যায় সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে বা মেট্রোপলিটনে যেখানে তা  উপনিবেশ স্থাপনাকারী দেশের পুঁজি পূঞ্জিতকরণে এবং বিনিয়োগে সহায়তা করে। উপনিবেশে কিন্তু সেক্ষেত্রে ওই হারে বিনিয়োগ করা হয় না।১৫ সেজন্য কেন্দ্র উপনিবেশে এমন সব শিল্প গড়ে তোলে যেখানে মজুরের প্রয়োজন বেশি। কিন্তু যেহেতু মজুরি কম তাই মুনাফার পরিমানও হয় প্রচুর।১৬ বাংলাদেশে ক্ষুদ্র দরিদ্র কৃষকরা কৃষি ছাড়াও জীবিকার জন্যে অতিরিক্ত কাজ খোঁজেন। কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে তারা সস্তা শ্রমের যোগান দেন।১৭ ঔপনিবেশিক উৎপাদন পদ্ধতির এই একটি দিক হচ্ছে সস্তা শ্রম পুনরুৎপাদন যা সামন্ত বা উন্নত ধনতান্ত্রিক নয়। তাছাড়া কৃষি এবং শিল্পের উদ্ধৃত্তের সিংহভাগই আত্মসাত করে মেট্রোপলিটন। হামজা আলাভী ও বানাজীর মতে ‘তৃতীয় বিশ্বের’ (পশ্চিম এই নামকরণ করেছে) সমাজ গঠনে একটি ঐতিহাসিক কিন্তু নির্দিষ্ট উৎপাদন পদ্ধতি কাজ করেছে, মার্কসের জীবদ্দশায় যা ছিল অজানা। কৃষিতে মজুর নিয়োগ করলেই যে বাংলাদেশের উৎপাদন চরিত্র পুঁজিবাদী হবে তা কিন্তু নয়। কৃষিতে বৃহদাকারে পুঁজিবাদি অর্থনৈতিক কাঠামোর মত পুঁজি পুনরুৎপাদনে কাজে লাগানো হয় না। তাছাড়া ভূমিহীন কৃষকরা যে কৃষিতেই মজুর খাটেন তা নয়। তারা জীবিকার জন্য অন্য কাজও করেন। বৃহদাকারে ধনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাংলাদেশের কৃষি পরিচালিত হয় না। বর্তমান বাংলাদেশে বা ঔপনিবেশিত দেশগুলোতে এখন উপনিবেশকাররা বা মেট্রোপলিটন শারীরিকভাবে দৃশ্যমান না হলেও তা রয়েছে অদৃশ্য ভূতের মতন। এই সাম্রাজ্যবাদী নয়া উপনিবেশবাদী ভূতই এক সময়ের উপনিবেশকে নয়া ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণ চালিয়ে এখানকার পুঁজি ও সম্পদ গিলে খায়- অবহেলিত ও বঞ্চিত করে রাখে ‘তৃতীয় বিশ্বের’ লক্ষ লক্ষ নিম্নবর্গের মানুষকে। সাম্রাজ্যবাদী মেট্রোপলিটনগুলো এজন্য প্রতিটি ঔপনিবেশিত দেশগুলিতে এজেন্ট তৈরী করে। এই এজেন্টদের মাধ্যমে মেট্রোপলিটনগুলো তাদের শোষণ চালিয়ে যায়। জারি  রাখে তাদের মতাদর্শ। এই শ্রেণীকে জাতীয় বুর্জোয়া আখ্যা দেয়া ভুল।

      ভারতের ইতিহাস ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মার্কসবাদী অনেক ঐতিহাসিক এবং মার্কসবাদী দলও  উপনিবেশবাদী, সাম্রাজ্যবাদী এবং জাতীয়তাবাদী ঘরানার ঘেরাটোপ দ্বারা এভাবে আবদ্ধ হয়ে যান। তাই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মার্কসবাদী দল ও মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের আরও সতর্ক হতে হবে। কার্ল মার্কস নিজেও প্রথম দিকে সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী কলাকৌশলে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। ১৮৫৩ সালে, ব্রিটিশ বিজয়ের পূর্বে ভারতীয় সমাজের বিষয়ে লেখার সময় ভারতীয় সভ্যতার হেগেলীয় ব্যাখ্যার বর্ণনামূলক উপাদানগুলোকে প্রারম্ভিক বিন্দু হিসেবে মার্কস গ্রহণ করেছিলেন বলে মনে হয়।১৮ হিন্দুদের কোনো ইতিহাস নেই, হেগেল বলেছিলেন, একটি পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক শর্তে বিস্তৃত হবার মতো বৃদ্ধিও এর নেই।১৯ হেগেল ভেবেছিলেন, বাঙালি সমাজ দৃঢ়বদ্ধ, অচল ও স্থবির। এর মধ্যে কোন ফাঁকফোকর নেই। হেগেল বলেন, ভারতীয় সংস্কৃতির স্বীকৃত পরিসমাপ্তি হলো ‘এক নিঃশব্দ কর্মহীন প্রসারণ।’২০ তাই,‘ভারতের জনগণ পরদেশকে জয় করতে পারেনি। অন্যদের কাছে কেবল পরাজিতই হয়েছে। মার্কস তার অতিপরিচিত অনুচ্ছেদে নিশ্চিতরূপে এই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন, ‘কোন ইতিহাস নেই ভারতীয় সমাজের, অন্তত কোনো পরিচিত ইতিহাস। এখানে ইতিহাস যাকে বলি তা হলো ধারাবাহিক অনুপ্রবেশের ইতিহাস, অপ্রতিরোধী-অপরিবর্তনশীল সমাজের নিষ্ক্রিয় ভিতের ওপরে তারা তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল।’২১ এছাড়া মার্কস ফিফ্থ রিপোর্ট এবং জেম্সমিলের বই পড়েও বেশ প্রভাবিত হয়েছেন বলে মনে হয়। তবে মার্কসের ভারত ইতিহাস সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা পরিবর্তিত হতে থাকে। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে কার্ল মার্কসই সর্ব প্রথম একে প্রথম ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে আখ্যায়িত করেন।২২ এ ব্যাপারে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ সম্পর্কে মার্কসের চিন্তা নিয়ে লিখেছেন ভারতীয় মার্কসবাদী ইতিহাসবিদ ইরফান হাবীব২৩ ও বাংলাদেশের মার্কসবাদী ঘরানার ইতিহাসবিদ আহমেদ কামাল।২৪ এছাড়া ইতিহাসবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেনও২৫ তার একটি প্রবন্ধে বলেছেন মার্কস এ বিদ্রোহে ভারতীয়দের অবদানকে প্রশংসা করেছিলেন এবং বিদ্রোহকে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো ভারতের মার্কসবাদী ইতিহাসকাররা এ ধারা অনুসরণ করতে পারেননি। তাছাড়া মার্কসিয় চিন্তা রিজিড কোন ব্যাপার না। এর অগ্রগতি আছে তা তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। মার্কস যে সময় ভারতীয় ইতিহাস সম্পর্কে বলেছেন, সে সময় ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক কিছুই ছিল অজানা, অনেক তথ্যই আবি®কৃত হয়নি। তাই মার্কসকে নির্ভর করতে হয়েছিল শুধুমাত্র সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসকারদের ওপর। ভারতের ইতিহাস নিয়ে যেসব মার্কসবাদী ইতিহাসকাররা কাজ করেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদী ঘেরাটোপে আবদ্ধ। ঘুরেফিরে অনেক মার্কসবাদী ইতিহাসবিদ ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহকে দেখাতে চেয়েছেন ফিউডাল রি-ত্র্যাকশন হিসেবে। এক্ষেত্রে এমএন রায়, রজনি পাম দত্ত, সুপ্রকাশ রায় থেকে সবার রচনায়ই উচ্চ বর্গের সরব উঁকিঝুঁকি  টের পাওয়া যায়। তাদের লেখনীতে আমরা বেশী খুঁজে পাই বাহাদুর শাহ, লক্ষীবাঈ এদের নামই বেশি। কিন্তু যে বিপুল সংখ্যক অধঃস্তন কৃষক, তাদের সন্তান, গ্রাম্য নিঃস্ব কৃষক, কামার, কুমোর এতে সংগঠিত হয়েছেন; সংগঠিত করেছেন তাদের বিস্তৃত বিবরণ কই? এক্ষেত্রে নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র একটি পান্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, বিদ্রোহে নিম্নবর্গের উপস্থিতি ছিল কত সরব।২৬ ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ সম্পর্কে ইতিহাসকার রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, এটি একটি মুসলমানদের বিদ্রোহ।২৭ রমেশচন্দ্রের বক্তব্যটি ছিল একটি রেসিস্ট এবং কমিউনালিস্ট মন্তব্য। কারণ কোনও একটি আন্দোলন সংগ্রামে মুসলমানদের অংশগ্রহণ বেশি থাকলেই যে একে মুসলমানদের বিদ্রোহ বলা যাবে এরকম কোন কথা নেই। এ সংগ্রামে যেমন মুসলমান ছিল, হিন্দু ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীও ছিল। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস তাদের ঞযব ঋরৎংঃ ধিৎ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব ১৮৫৭-১৮৫৯, প্রবন্ধে মহাবিদ্রোহে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠী অংশগ্রহন করেছিল বলে বলেন এবং এই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানান।২৮ তাহলে রমেশচন্দ্রের কথানুযায়ী ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কি আমরা মুসলমানদের যুদ্ধ বলব না শোষিত নীপিড়িত পূর্ববাংলার মানুষের সংগ্রাম বলব। ১৯৭১-র মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু মার্কসবাদীদের মন্তব্য দুঃখজনক। তাদের কেউ কেউ এ যুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই বলেছেন।২৯ তবে মার্কসবাদীদের বিরাট অংশ এ লড়াইকে আঞ্চলিক উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শোষিত নিপীড়িত মানুষের লড়াই হিসেবে দেখেছেন এবং লড়েছেন নিপীড়িত মানুষের কাতারবর্তী হয়েই। সেক্ষেত্রে আধা বুর্জোয়া গোষ্ঠীই ছিল দ্বিধাগ্রস্ত এবং ম্লান। এ ব্যাপারটি পরিষ্কারভাবে মেসবাহ কামাল দেখিয়েছেন তার উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান, শহীদ আসাদ ও শ্রেণী রাজনীতি প্রসঙ্গ বইতে।৩০ সেখানে তিনি দেখিয়েছেন শ্রেণী লড়াই কিভাবে কাজ করেছে উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানে নিম্নবর্গের মানুষেরা কিভাবে লড়েছে। তাদের ক্রমবর্ধমান দাবী এবং লড়াইয়ের মুখে কীভাবে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন আধা বুর্জোয়া নেতৃবৃন্দ। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই সংগ্রামে অগ্রগামী ছিলেন নিম্নবর্গই।৩১ তাই যেটা বলতে চাচ্ছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে যদি দুই বুর্জোয়া অংশের লড়াই হিসেবে দেখানো হয়, সেটা হবে ঐতিহাসিক ভুল। তাতে করে এ লড়াই সংগ্রামের পুরো কৃতিত্ব চলে যাবে উচ্চবর্গের হাতে।

ভারতীয় উপ-মহাদেশের ইতিহাসের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস তত্ত্ব যে কাজটা করেছে তা হলো উপনিবেশিত দেশগুলোকে হেয়, বর্বর ও অসভ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিভিন্নভাবে দেখাতে চেয়েছে উপনিবেশিত দেশগুলো ভারতে উপনিবেশ স্থাপন করে ভারতীয়দের উপকারই করেছে। ভারতীয়দেরকেই পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে সভ্য করেছে, গণতন্ত্রীমনা করেছে।৩২ কিন্তু পাশ্চাত্য যে গণতন্ত্রের কথা বলছে ওই গণতন্ত্রের আদি ফর্ম ভারতে অনেক আগেই ছিল। এমন সময় ছিল, পাশ্চাত্য যখন সভ্যতার আলোর খুব দূরে ছিল, সেই পাল আমলে সবাই মিলে গণতান্ত্রিকভাবে (যত ক্ষুদ্রই হোক ) গোপালকে শাসক নির্বাচিত করেছিল । ভুল বুঝবেন না আমি ‘গণতন্ত্রের’ মহিমা  কীর্ত্তন করছি না বা ভারতকে গণতন্ত্রিক রাষ্ট্র প্রমান করার কোন প্রকল্পে নামিনি । যে কথা বলছিলাম, পাশ্চত্য বলছে  উপনিবেশের  ভূমি পুত্ররা স্যাভেজ, তাদের ধর্ম-সংস্কৃতি সব  হচ্ছে অবৈজ্ঞানিক, কুসংস্কার। উপনিবেশবাদি পশ্চিম দেখাচ্ছে, হিন্দু ধর্ম গোড়া, কুসংস্কারাচ্ছন্ন । আর এখানকার ইসলাম মানে সন্ত্রাসের ধর্ম। মুসলমান  মানে টেররিস্ট। এটা প্রমান করতে ওয়েস্ট এখন গাঁট বেধে নেমেছে।৩৩ অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রমান করতে চাইছে ভারত এবং অন্যান্য উপনিবেশিত দেশের মানুষেরা  হয় বর্ণগোড়া বা টেররিস্ট ধর্মের অবলম্বী। কিন্তু  একটা ব্যাপার হয়ত আমরা  ভাবছি না, পশ্চিমে যে ধর্ম বেশী চর্চিত তা হলো  খ্রিষ্টান ও ইহুদি ধর্ম। সেটা কি? খ্রিষ্টান ধর্মের মধ্যে দীর্ঘব্যাপী যুদ্ধের কথা আমরা জানি। হলোকাস্টের কথা আমরা জানি। বরং ভারতীয় উপমহাদেশে অধিক চর্চিত ধর্ম ‘হিন্দু’  ও ‘ইসলামের’ মধ্যে একটি সামষ্টিক এ্যাটিচিওড রয়েছে। হিন্দু ধর্মে রামকৃষ্ণ পরমহংসের যে পথ তা বরং অনেক সামষ্টিক ও সমন্বয়ধর্মী। এ অঞ্চলে ইসলামের একটি সমন্বয়ধর্মী বৈশিষ্ট্য রয়েছে।৩৪ ঔপনিবেশিক শক্তি এখানকার মানুষের সংস্কৃতি ও ধর্মে আঘাত করে এই সামাজিক এ্যাটিচিওডটা  ভেঙে দিতে চেয়েছিল।

গ্রামাঞ্চলে বসন্ত রোগের টিকা দেওয়ার মাধ্যমে কিভাবে ঔপনিবেশিক শক্তি নিম্নবর্গের  সামাজিক চেতনাকে ভেঙে দিতে চেয়েছে, দীপেশ চক্রবর্তী তা দেখিয়েছেন তার প্রবন্ধ ‘শরীর, সমাজ ও রাষ্ট্র: উপনিবেশিক ভারতে মহামারি ও জনসংস্কৃতি প্রসঙ্গে।’ যে কথাটি আমি বলতে চাচ্ছি তা হলো উপনিবেশবাদী ও সম্রাজ্যবাদী ইতহাসবিদরা উপনিবেশগুলোর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এমনভাবে নির্মাণ করেছে তা হলো ‘অপর’ । এই অপর কোন পজেটিভ ‘অপর’ নয়।৩৫ উপনিবেশের মানুষরা অসভ্য এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এদের সভ্য করা দরকার। বিল্পবী তাত্ত্বিক এইমে সেজার দেখিয়েছেন পশ্চিমাদের এই থিওরির কতো অসাঢ়।৩৬ পশ্চিমা সম্রাজ্যবাদী তাত্ত্বিক ও ইতিহাসকাররা যে সভ্যতার কথা বলেন, মানবিকতার কথা বলেন, আধুনিকতার কথা বলেন, সেই যুগেই উপনিবেশগুলিতে চলে মানুষের ওপর চরম নিপীড়ন। উপনিবেশকাররা মাদাগাস্কারে হত্যা করে হাজার হাজার মানুষ।

        সাম্রাজ্যবাদী  তাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদরা তত্ত্ব দেন যে এশিয়া, আফ্রিকা এবং অন্যান্য দেশগুলি উপনিবেশিত হয়েছিল তার কারণ ’ দ্যা ডেজার্ভ ইট ’ মনোবিশ্লে¬ষক ও তাত্ত্বিক ফ্রানৎস্ ফাঁনোও সেই তত্ত্ব খারিজ করে দেন।৩৭  তিনি দেখান শারীরিক ও মানসিক গঠনগত দিক দিয়ে এরকম কোন বিশেষ পার্থক্য নেই যে কারণে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো উপনিবেশবাদ ডেজার্ভ করে কিন্ত পশ্চিমা মানুষেরা তা ডেজার্ভ করে না ।৩৮


এলিট জাতীয়তাবাদী ইতিহাসকাররা সাম্রাজ্যবাদী ইতহাসতত্ত্বের অনেক দিকগুলো সমালোচনা করলেও যেটি তাদের স্বার্থের সাথে মিলে যায় সেটি গ্রহন করেন তারা। উপনিবেশের জাতীয়তাবাদী এলিট ইতিহাসকার, তাত্ত্বিক ও সাহিত্যিকরা উপনিবেশবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, নিপীড়ন ও ইতিহাসের বিরোধীতা করলেও তাদের ভাবনার জগতে বিরাজ করে ঔপনিবেশিক আধিপত্য । এক্ষেত্রে নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদ রনজিৎ গুহ তাঁর গবেষণা প্রবন্ধ ‘ঞযব রসধমব ড়ভ ধ ঢ়বধংবহঃ ৎবাড়ষঃ রহ ধ ষরনবৎধষ সড়হরঃড়ৎ’-এ দেখিয়েছেন তিনি শিক্ষিত এলিট শ্রেণীর ভাবনার জগতে কিভাবে ঔপনিবেশিক আধিপত্য বিস্তার করেছিল।৩৯ মীর মোশাররফ হোসেনের জমিদার দর্পন এবং দীনবন্ধু মিত্র নীল দর্পন লিখলেও শেষ পর্যন্ত তার গতিমুখ সাম্রাজ্যবাদী জ্ঞানতত্ত্বের ভেতরেই। নীলকর ও জমিদারদের বিরুদ্ধে লিখলেও তা আসলে মূল শোষককে খুঁজে বের করতে পারেনি। গ্রামশির তত্ত্বানুযায়ী  এদের বলতে পারি ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধিজীবি।৪০ ঔপনিবেশিক কাঠামোয় ঐতিহ্যবাহী জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবিরা সবকিছুকে ভালো ও খারাপ এ দু’টি সরল ভাগে ভাগ করেছিলেন। তাঁরা বলছেন, দেশে যত অন্যায় হচ্ছে তার জন্য খারাপ ইংরেজ ও খারাপ জমিদার দায়ী। গুহ দেখিয়েছেন, জমিদার দর্পনে মীর মোশাররফ কিভাবে উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদী  আধিপাত্য দ্বারা আবর্তিত । মোশাররফের  জমিদার দর্পনের নায়ক জমিদার মুসলমান। তিনি মুসলমান ও হিন্দু জমিদারকে  দু’টি দলে ভাগ করেছেন। উপন্যাসে ভিলেন জমিদার হাওয়ান কামুক ও অত্যাচারী । আবু মোল্ল¬া তার রায়ত। মোল্লার স্ত্রী নূরন্নেহার সুন্দরী। হাওয়ান তাকে হস্তগত করতে চায় এবং এজন্য সে আবু মোল্ল¬ার ওপর অত্যাচার করে এবং নূরন্নেহারকে জবরদস্তি করে তুলে আনে, ধর্ষন করে, নূরন্নেহারের মৃত্যু হয়। সে আইনের আশ্রয় নেয়। কারণ আইন তো জমিদারের নয়, মহারানীর।  অত্যচারী জমিদারের মুখেও মোশাররফ ব্রিটিশ আইনের কীর্ত্তন গাওয়ান। হাওয়ান বলে, এখন ইংরেজি আইন বিষদাঁত ভাঙ্গা । 

উপনিবেশবাদীদের আধিপত্য কীভাবে এলিট জাতীয়তাবাদী ঘরানার বুদ্ধিজীবিরা বিস্তার করেছে তার পরিচয় নূরন্নেহারের পরিনতি দেখা যায় নূরন্নেহারের চরিত্র চিত্রনে। নূরুন্নেহার ধর্ষিত হয়, প্রজা প্রহƒত হয় কিন্তু তারা রুখে দাঁড়ায় না বরং ভারতেশ্বরী ও  তার আইনের প্রতি এদের শ্রদ্ধা কয়েকগুন বেড়ে যায়। মৃত্যুপথযাত্রী নূরন্নেহারের মুখ দিয়ে মোশাররফ হোসেন নিঃসৃত করান এমনই উক্তি- ‘শুনেছি যে মহারানী সকলের উপরে বড়, সাহেবদের উপরেও বড় । আমরা যেমন প্রজা তেমনি তুমিও তার প্রজা। তিনি কি এর বিচার করবেন না? প্রজা বলে কি তার দয়া হবে না? মা, তুমি বেলাতে থাক। তোমার প্রজার প্রতি এত দৌরাÍ্য হচ্ছে তুমি কি জানতে পাচ্ছনা? কেবল বড় বড় লোকই তোমার প্রজা।  আমরা গরীব বলে তুমি কি আমাদের মা হবে না?৪১ এভাবে মধ্যবিত্ত জাতীয়তাবাদী শিক্ষিত এলিটদের সকল সাহিত্য, ইতহাসতত্ত্ব ও মতাদর্শ সব আবর্তিত হয় উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী কাঠামোর মধ্যেই। সুমিত সরকার তাই তাঁর গ্রন্থ ইবুড়হফ ঘধঃরড়হধষরংঃ ভৎধসব-এ বলেছেন, একটি আধিপত্যহীন ইতিহাস রচনার জন্য আমাদের এই  ঘধঃরড়হধষরংঃ ভৎধসবড়িৎশ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।৪২ এলিট শ্রেণী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংগ্রামে পাশ্চাত্য শিক্ষা, রেললাইন, তারযন্ত্র এসবকে গুরুত্ব দিয়ে জায়েজ করে নিজেদের অবদানকে । আর শক্তিশালী কৃষক বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ১৮৫৭- এর মহাবিদ্রোহকে প্রমান করার চেষ্টা করে প্রাক রাজনৈতিক, প্রাক-জাতীয়তাবাদী।


আমরা এখানে বিরাজমান যে তিনটি ইতিহাস তত্ত্ব দেখেছি (১) সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস তত্ত্ব (২) জাতীয়তাবাদী এবং (৩) মাকর্সবাদী ইতিহাসতত্ত্ব। এর মধ্যে  সম্রাজ্যবাদী ইতিহাস তত্ত্ব  উপনিবেশকে হেয় করতে চেয়েছে যুক্তিহীনভাবে। কারণ অনেক ঐতিহাসিক উপনিবেশকদের অসারতা প্রমাণ করেছেন। জাতীয়তাবাদী ইতহাসতত্ত্ব, যেটা আগে বলেছি , সাম্রাজ্যবাদী  ইতিহাস তত্ত্বেরই বর্ধিত এবং সংস্করণ রূপ। তাই গণমানুষের  একটি সৃষ্টিশীল  বৈজ্ঞাািনক ইতিহাস চর্চার জন্য তা গ্রহনযোগ্য নয়। আর ভারতীয় ইতিহাস চর্চায়  কিংবা বিশ্ব ইতিহাস চর্চায় মাকর্সবাদ যে একটি বড় বিপ্লব এনেছে তা অস্বীকার করা যাবে না । মাকর্সবাদী ইতিহাসতত্ত্ব ইতিহাসকে ‘টোটাল’ ইতিহাস পর্যায়ে  উন্নীত করেছে।৪৩ কিন্তু ভারতীয় ইতহাস চর্চার ক্ষেত্রে এখানকার অনেক মার্কসবাদী ইতিহাসকার ও তাত্ত্বিকদের সীমাবদ্ধতা লক্ষ্যণীয় । সেক্ষেত্রে নিম্নবর্গের ইতহাস চর্চাকারীরা একটা রেডিক্যাল জায়গায় অবস্থান করছেন। তাদের ইতিহাস চর্চার শুরুই উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসতত্ত্বের বিরোধীতার মধ্য দিয়ে। তবে এটা মনে রাখতে হবে, নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা একটি আলাদা স্কুল হলেও তা মার্কস্বাদী ইতহাস ঘরানা থেকে ফিলজফিকাল্লি দূরবর্তী নয় । বলা যায় নিম্নবর্গের  ইতিহাস চর্চা মার্কসবাদী ইতিহাস চর্চারই বর্ধিত রুপ এবং মার্কসাবাদী  ইতিহাস চর্চার  সহায়ক হতে পারে । নিম্ন বর্গের ইতিহাস চর্চার যে নামটি নেওয়া হয়েছে দঝঁনধষঃবৎহ ঝঃঁফরবং’ তাও ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামশির (১৮৯১-১৯৩৭) কারাগারের নোটবইয়ে ‘সুবলতার্ন’ শব্দ থেকে।৪৪ ইংরেজী ভাষায় সাবলটার্ন শব্দটি বিশেষভাবে  ব্যবহƒত হয় সামরিক সংগঠনের ক্ষেত্রে । ক্যাপ্টেনের অধস্ত—ন অফিসারদের বলা হয় সাবলটার্ন। এজন্য তপন রায় চৌধুরী কৌতুক করে নিম্নবর্গের ইতহাস চর্চাকে হাবিলদার চর্চা বলেও অভিহিত করেছেন তার বাঙালনামায়।৪৫ তবে শব্দটির  সাধারণ অর্থ অধঃস্তন বা নিম্নস্থিত। আরিস্ততেলীয় ন্যায়শাস্ত্রে এর অর্থ এমন একটি প্রতিজ্ঞা যা অন্য কোন প্রতিজ্ঞার  অধীন বিশিষ্ট মূর্ত। সার্বিক নয়। সাধারণ অর্থে ইরেজীতে এর সমার্থক শব্দ হল ‘সাবর্ডিনেট’। সাবলটার্ন (ইতালীয়তে সুবলতের্নো) শব্দটি গ্রামশি ব্যবহার করেছেন অন্তত দুটি অর্থে। একটি অর্থে এটি সরাসরি ভাবে ‘প্রলেটারিয়েতেরই’ প্রতিশব্দ। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সাবলটার্ন শ্রেণী হল শ্রমিকশ্রেণী। সামাজিক ক্ষমতায় এক বিশেষ ধরনের বিন্যাস ও প্রক্রিয়ার মধ্যে শ্রমিকশ্রেণী শোষিত ও শাসিত হয়। এই বিন্যাস সার্বলটার্ন শ্রমিকবেশীর বিপরীত মেরুতে অবস্থিত ‘হেজেমনিক’ শ্রেণীর অর্থাৎ  পুঁিজমালিক, বুর্জোয়া এই বিশ্লেষণে গ্রামশি গুরত্ব দিয়েছেন সেই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটির ওপর যার মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণী কেবল শাসনযন্ত্রে তার প্রভুত্বই প্রতিষ্ঠা করে না সৃষ্টি করে এক সার্বিক  সামাজিক কর্তৃত্ব বা ‘হেজেমনি’। কেবল রাষ্ট্রীয় শক্তিকে অবলম্বন করে এই সার্বিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না ।  সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের জগতে এক আমুল পরিবর্তন ঘটিয়ে ‘হেজেমনিক’ বুর্জোয়া শ্রেণী তার শাসনের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে সাবলটার্ন শ্রমিকশ্রেণীর কাছ থেকে সামাজিক সম্মতি আদায়ের চেষ্টা করে। কিন্তু যেখানে পুঁজিবাদ উৎপাদন ব্যবস্থার অসম্পূর্নতায় প্রভুত্ব/অধীনতার সম্পর্ক কাজ করে সামন্ত শ্রেণীর প্রভুত্ব ও কৃষক শ্রেণীর অধীনতার মধ্য দিয়ে। গ্রামশি প্রভুুত্ব/অধীনতা সম্পর্কের সাধারণ চরিত্রটির সন্ধান করেছেন প্রধানত সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের  ক্ষেত্রগুলিতে। দু‘টি মূল ঝোঁক কাজ করেছে তার মধ্যে । একদিকে ইউরোপীয় মার্কসবাদের আদিপর্বে কৃষকের সংস্কৃতি, ধ্যানধারণা, আচার-আচরণ ও রাজনৈতিক সম্ভাবনা সম্পর্কে যে তাচ্ছিল্যের আর অবজ্ঞার ভাব ছিল, তার বিরুদ্ধে গ্রামশি বলে গেছেন, ‘সাবলটার্ন কৃষকদের প্রাত্যহিক জীবনযাপন, ধর্মবিশ্বাস, রাজনৈতিক ধ্যানধারণার বিশিষ্ট সমস্যাগুলিকে গভীরভাবে অনুসন্ধান করা ও বোঝার প্রয়োজনের কথা। একই সঙ্গে তিনি কৃষক চেতনার সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন।৪৬ সম্প্রতি ভারতবর্ষের ইতিহাস গবেষনায় সাবলটার্ন শ্রেণীর ধারণা ও তাদের ইতিহাসে অংশগ্রহনের কথা বলেছেন রনজিৎ গুহের নেতৃত্বে একদল ঐতিহাসিক। তারা তাদের বিভিন্ন গ্রন্থ , ঊষবসবহঃধৎু অংঢ়বপঃ ড়ভ ঃযব চবধংধহঃ ওহংঁৎমবহপু রহ ঈড়ষড়হরধষ ওহফরধ (জধহধলরঃ এঁযধ); উড়সরহধহপব রিঃযড়ঁঃ ঐবমবসড়হু (জধহধলরঃ এঁযধ) ঢ়ৎড়ারহপরধষরুরহম ঊঁৎড়ঢ়ব (উরঢ়বংয ঈযধশৎধনধৎঃর), ঐরংঃড়ৎু ধহফ চৎবংবহঃ (চধৎঃযধ ঈযধঃবৎলবব); চৎরহপবষু ওসঢ়ড়ংঃবৎ (চধৎঃযধ ঈযধঃবৎলবব) বইগুলোতে বলেছেন ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন সংগ্রামে নিম্নবর্গের উপস্থিতি এবং সীমাবদ্ধতার কথা। এ পর্যন্ত নিম্ন বর্গের ইতহাস চর্চার ১৩টি ভল্যুম বেরিয়েছে। এছাড়া আলাদা ভাবে তাদের বিভিন্ন গ্রন্থতো রয়েছেই। প্রথমদিকে তাঁরা শুধু ইতিহাসে নিম্নবর্গের উপস্থিতির কথা দেখালেও এখন এ ইতিহাসকাররা নিম্নবর্গের চেতনার সীমাবদ্ধতার কথাও বলছেন। 

নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার ফলে মাকর্সীয়  ইতিহাসতত্ত্ব  ও বিশ্লে¬ষন পদ্ধতির অনেক নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে  উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী  ইতিহাস চর্চার এনকাউন্টারে গড়ে উঠেছে নতুন ইতিহাস ঘরানা (আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, দক্ষিন পূর্ব এশিয়া এমনকি বাংলাদেশেও গড়ে উঠেছে সাবলটার্ন ইতিহাস চর্চা ঘরানার ইতিহাস চর্চা গোষ্ঠি জন ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র।

       তবে নিম্ন বর্গের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে অনেক সমালোচনার জায়গাও এসেছে। নিম্ন বর্গের ইতিহাস  চর্চাকারীরা উপনিবেশিক তথ্য উপাত্তকে  বিপরীত পাঠ দিচ্ছেন তা বিজ্ঞান সম্মত কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে । এছাড়া নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চাকারীরা যে নিম্নবর্গের কথা বলছেন, সে নিম্নবর্গ কি কথা বলতে পারে কিনা সে প্রশ্ন তুলেছেন গায়ত্রী চক্রবর্তী।৪৭ তবে সে যাই হোক নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা ইতিহাস চর্চায় এনেছে নতুন গতিমুখ। গোটা উপনিবেশবাদী ইউরো কেন্দ্রিক ইতিহাসের বিপরীতে নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা এখন ইতিহাস চর্চায় নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে, যা সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী আধিপত্যকে কেন্দ্রচ্যুত করবে।



তথ্যপঞ্জি

১.    এ.ড.ঋ ঐবমবষ, চযরষড়ংড়ঢ়যু ড়ভ ঐরংঃড়ৎু, ঘবি ণড়ৎশ ১৯৫৬
২.    গৌতম ভদ্র এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়; নিম্নবর্গের ইতিহাস; আনন্দ ২০০৪।
৩.    ঊ.ঔ ঐড়নংনধসি ধহফ এ.জঁফব; ঈধঢ়ঃধরহ ঝরিহম খড়হফড়হ ১৯৬৯
৪.    ঊ.ঔ ঐড়নংনধসি; চৎরসরঃরাব জবনবষং; গধহপযবংঃবৎ, ১৯৫৯
৫.    মুনতাসীর মামুন এবং সৈয়দ আনোয়ার হোসেন সম্পাদিত বাংলাদেশের সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাস, এশিয়াটিক সোসাইটি।
৬.    গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত
৭.    বিনয় ঘোষ, বাংলার নবজাগৃতি, ওরিয়েন্ট লংম্যান ১৯৭৯
৮.    গৌতম ভদ্র এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত
৯.    বাসদ, বাংলাদেশের উৎপাদন কাঠামো ও  রাষ্ট্রচরিত্র; ঢাকা ১৯৯০
১০.    বাসদ, প্রাগুক্ত
১১.    ঋৎধহঃু ঋধহড়হ; ঞযব ডৎবঃপযবফ ড়ভ ঃযব ঊধৎঃয;  চবহমঁরহ ২০০১
১২.    গধৎী; ঋঁঃঁৎব জবংঁষঃং ড়ভ ইৎরঃরংয জঁষব রহ ওহফরধ , ঘবি ণড়ৎশ উধরষু ঞৎরনঁহব ১৮৫৩
১৩.    কধৎষ গধৎী; প্রাগুক্ত
১৪.    মুনতাসীর মামুন; উনিশ শতকে পূর্ব বঙ্গের সমাজ; সাহিত্য বিলাস; ঢাকা ২০০৬
১৫.     ঐধসুধ অষধার, ‘ওহফরধ ধহফ ঃযব ঈড়ষড়হরধষ সড়ফব ড়ভ চৎড়ফঁপঃরড়হং’, জধষঢ়য গরষরনধহফ ধহফ লড়যহ ঝধারধষষব (বফঃ) ঞযব ঝড়পরধষ জবমরংঃবৎ; খড়হফড়হ ১৯৭৫; মুনতাসীর মামুনের উনিশ শতকের পূর্ব বঙ্গের সমাজ থেকে উদ্ধৃত।
১৬.    ঐধসুধ অষধার; ওনরফ
১৭.    মুনতাসীর মামুন; প্রাগুক্ত
১৮.    ইরফান হাবীব ; ভারতবর্ষের ইতিহাস প্রসঙ্গ; ন্যাশনাল বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড; কলকাতা ২০০২।
১৯.    এ.ড.ঋ ঐবমবষ; ওনরফ
২০.     এ.ড.ঋ ঐবমবষ; ওনরফ
২১.    কধৎষ গধৎী; ওনরফ
২২.    গধৎী ধহফ ঊহমষবং; ঞযব ঋরৎংঃ ধিৎ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব; ঞৎরনঁহব ১১ ঔঁষু ১৮৫৩
২৩.    ওৎভধহ ঐধনরন; টহফবৎংঃধহফরহম ১৮৫৭, চবড়ঢ়ষবং উবসড়পৎধপু, সধু ২০০৭ িি.িপঢ়রস.ড়ৎম/ঢ়ফ/২০০৭/০১৩২০০৭-রৎভধহ.যঃস
২৪.    আহমেদ কামাল; নতুন দিগন্ত ২০০৭
২৫.    সৈয়দ আনোয়ার হোসেন; সিপাহী জনতার মহাবিদ্রোহ, ১৮৫৭ একতা ২০০৭।
২৬.    এধঁঃধস ইযধফৎধ; ঋড়ঁৎ জবনবষং ড়ভ ঊরমযঃববহ ভরভঃু ঝবাবহ; ংঁনধষঃবৎহ ংঃঁফরবং াড়ষ-৪, ড়ীভড়ৎফ
২৭.    জড়সবংয ঈযধহফৎধ গধলঁসফবৎ; ঞযব ংবঢ়ড়ু সঁঃরহু ধহফ ঃযব জবাড়ষঃ ড়ভ ১৮৫৭; ১৯৫৭
২৮.    গধৎী ধহফ ঊহমষবং, ওনরফ
২৯.    বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর; ইতিহাস নির্মানের ধারা; বাংলাদেশ চর্চা; ২০০৫, ঢাকা।
৩০.    মেসবাহ কামাল, উন সত্তরে গণ অভুত্থান; শহীদ আসাদ ও শ্রেণী রাজনীতি প্রসঙ্গ; শ্রাবন, ঢাকা ২০০৭।
৩১.    মেসবাহ কামাল, স্বাধীনতা সংগ্রামে বামপন্থীদের ভূমিকা, কলকাতা, ২০০৬
৩২.    অরসব ঈবংধরৎব; উরংপড়ঁৎংব ড়হ ঈড়ষড়হরধষরংস; সড়হঃযষু জবারবি ২০০০.
৩৩.    ঊফধিৎফ .ি ংধরফ; ঈড়াবৎরহম ওংষধস; ঠরহঃধমব ১৯৯৭
৩৪.    মুনতাসীর মামুন; বাংলাদেশ বাঙালি মানস রাষ্ট্রগঠন ও আধুনিকতা; সময়-২০০৭, ঢাকা।
৩৫.    ঊফধিৎফ ড ঝধরফ; ঙৎরবহঃধষরংস, চবহমঁরহ ২০০৪
৩৬.    অরসব ঈবংধরৎব, ওনরফ
৩৭.    ঋৎধহঃু ভধহড়হ; ইষধপশ ঝশরহ যিরঃব গধংশ; এৎড়াব ঢ়ৎবংং ওহপ ১৯৬৭.
৩৮.    ঋৎধহঃু ঋধহড়হ; ওনরফ
৩৯.    রনজিৎ গুহ; প্রাগুক্ত
৪০.    অহঃড়হরড় এৎধসংপর; ঝবষবপঃরড়হং ঋৎড়স ঃযব চৎরংড়হ ঘড়ঃব নড়ড়শং, ঙৎরবহঃ ষড়হমসধহ ২০০৪
৪১.    রনজিৎ গুহ; প্রাগুক্ত
৪২.    ঝঁসরঃ ঝধৎশধৎ; ইবুড়হফ ঘধঃরড়হধষরংঃ ঋৎধসব : জবষড়পধঃরহম ঢ়ড়ংঃসড়ফবৎহরংস, ঐরহফঁঃাধ, ঐরংঃড়ৎু, চবৎসধহবহঃ ইষধপশ ২০০৫
৪৩.    ঊ. ঝযৎবফযধৎধহ; অ ঃবীঃ নড়ড়শ ড়ভ ঐরংঃড়ৎরড়মৎধঢ়যু; ঙৎরবহঃ ষড়হমসধহ
৪৪.    এৎধসংপর; ওনরফ
৪৫.    তপন রায় চৌধুরী; বাঙালনামা; আনন্দ মে ২০০৭
৪৬.    এৎধসংপর; ওনরফ
৪৭.    এ. ঝঢ়রাধশ, ঈধহ ঝঁনঁষঃবৎহ ঝঢ়বধশ; চড়ংঃ ঈড়ষড়হরধষ ঝঃঁফরবং; জড়ঁঃযষবফমব ২০০৪;




1 comment:

  1. আমি পশ্চিমবঙ্গ থেকে সুশান্ত পাল বলছি। আজিজুল রাসেল ভাইয়ের সঙ্গে একবার যোগাযোগ করতে চাই। আমরা অভিক্ষেপ ( abhikhhep.com ) নামে একটা ওয়েব ম্যাগাজিন প্রকাশ করি। ওনার এই লেখা আমরা আমাদের পত্রিকার নিম্নবর্গের প্রতিরোধ সংখ্যাতে পুনর্মুদ্রণ করতে ইচ্ছুক। ওনার অনুমতি নিতে চাই। আমার whatsapp number— +919153120820

    ReplyDelete